আকাঙ্ক্ষার চিরকুট


ভীষণভাবে কোনো হৃদয়ছোঁয়া কবিতা পড়তে ইচ্ছে করছে। খুঁজে পাচ্ছি না। তেমন কেউ নেই যে খুঁজে দিয়ে বলবে, ‘পড়ো’। কিংবা প্রতিদিন খুঁজে খুঁজে দু একটা সুর আমাকে পাঠিয়ে বলবে, ‘শুনে জানিও, কেমন লাগলো’। অথবা কিছু এলোমেলো কথা লিখে জানাবে, ‘তোমার ওপর অভিমান করে লিখেছিলাম। পড়ে বোলো কেমন লাগল’।

এটুকু কখনও কারো কারো ওপর অত্যাচার হয়ে দাঁড়ায়। আমি এই অত্যাচারটুকুই প্রত্যাশা করি। কিন্তু যেমনটা সবসময় হয়, যার চাওয়া, সে পায়না। যার পাওয়া, সে চায় না।

মাঝে মাঝে কী ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে! মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে আবার ঘুমোবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা চলে। নিজের সাথে নিজের লুকোচুরির পর উঠে পড়ে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে মনে হয়, কারো সাথে কথা বলতে পারলে বেশ হত। কিংবা নিদেনপক্ষে দু একটা খুদেবার্তা। কিন্তু কেউ যে নেই। প্রিয় মানুষেরা অতল ঘুমে।

কিছু শব্দবিন্যাস মাথায় ঘুরঘুর করছে দিনকয়েক ধরে। “Life is too damn short to follow all these rules”. গ্রে’স এ্যানাটমি থেকে পাওয়া। মেরেডিথের ন্যারেশানগুলো চমৎকার। জীবনবোধ সম্পন্ন। সত্যিই, জীবন এতকিছু মেনে চলার জন্যে ভয়াবহভাবে ক্ষুদ্র। সামাজিকতা, কৃত্রিমতা, কুটিলতা, জটিলতা, অভিনয়- এ সবকিছুর জন্যে জীবনটা খুব খুব ছোট।

এ ছোট জীবনে কত কিছু করা হয়ে উঠবে না। কত কথা কত মানুষকে বলতে গিয়েও বলা হবে না। কখনও হয়ত সকালে উঠে সারাদিনের কাজকর্মের একটা লিস্ট করে দুপুরে হুট করে মরে যাবো।

আজও যেমন অনেক কথা বলবার জন্যে লিখতে বসেও কিছু গুছিয়ে উঠতে পারছি না। নানামুখী চিন্তা আর কর্মপরিকল্পনা আর তার বাস্তবায়ন না করা সংক্রান্ত দুশ্চিন্তা কিছুক্ষণ পরপরই আক্রান্ত করছে।

আজ আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। বিশাল দিনলিপি লিখবার নিয়মটুকু ভাঙলাম নাহয়। Life is too damn short to follow all these rules..

Life, Luck, Love!


Life, Luck, Love: Such three mystery!

হুট করেই রাতে এই তিন L আদ্যাক্ষরের শব্দের মিল খুঁজে পেলাম। তিনটার কোনোটাই আমাদের হাতে নেই। চাইলেই মৃত থেকে বেঁচে ওঠা যায় না। কিংবা হুট করে বিষাদে আক্রান্ত হয়ে মরে যাওয়া যায় না। সাহস চাই। চাইলেই ভাগ্যকে বদলে ফেলা যায় না। যায় না হুট করে ভালোবাসা পাওয়া। বিধাতাপ্রদত্ত এই তিনটে জিনিসই যার আছে, তাকে সৌভাগ্যবান বললেও কম বলা হয়ে যায় হয়ত।

আমি? সৌভাগ্যবান? জানি না।

কথাপ্রসঙ্গে ভাগ্যের বিষয়টা উঠল। ইদানিং বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে আমি খুব খারাপ। নিষ্ঠুর। হৃদয়হীন। স্বার্থপর। না-বাচক সব বিশেষণই আমার জন্যে প্রযোজ্য। বিপরীতে উত্তর আসে, ‘না, সৌভাগ্যবান’। খারাপ মানুষেরা সৌভাগ্যবানই হয়।

ভাগ্য শব্দটা কে প্রথম আবিষ্কার করেছিল জানি না। আমাদের সাফল্য ব্যর্থতা, সুখ দুঃখ, ঘটনা দুর্ঘটনা- সবকিছুই কি ভাগ্য দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয়? কেউ বলে, কাকতালীয়। তবুও কেন আমরা ভাগ্য নামক বিষয়টায় বিশ্বাস করি? জানা নেই।

কেউ বলে, দুর্বলরাই ভাগ্যে বিশ্বাস করে। কিন্তু ধরো, প্রচণ্ড পরিশ্রমী একজন যখন খেটেখুটে আবিষ্কার করল, তার পরিশ্রম বৃথা? এটা কি ভাগ্য? না কাকতালীয়? জানি না। কিচ্ছু জানি না।

এক ছোট ভাই, আহনাফ। রেসিডেন্সিয়ালে পড়ে। প্রচণ্ড মেধাবী। বলা চলে, বিধাতা তাকে দু হাত ভরে দিয়েছেন। অন্তত আমি তাই বলব। কিন্তু সে এখন লিউকেমিয়ার সাথে লড়ছে। এটা কি ভাগ্য না দুর্ভাগ্য? প্রতিবার আহনাফদের মত মানুষদের দেখি, আর স্থির সিদ্ধান্তে পৌছে যাই। জীবন কি তুচ্ছ, কি অসহায়!

আমার ব্লগে অসংখ্যবার এই কথাটা আমি বলেছি। জীবনের তুচ্ছতাকে আবিষ্কার করেছি বারংবার। জীবনের অসহায়তার মাত্রাধিক্যে বিস্মিত হয়েছি। এত কর্মযজ্ঞ, এত সাধনা, এত পরিশ্রম, এত অনুভূতি – সব তবে বৃথা? সব এই ভাগ্য নামক অদৃশ্যের হাতে বন্দি? এই তুচ্ছ জীবনের কি মানে?

জানা নেই। জানা নেই।

ভালোবাসার স্থায়িত্বও তো মহাকালের হিসেবে ন্যানোসেকেণ্ড মাত্র। মায়াটুকু থেকে যায় কেবল। ভালোবাসা আর মায়ার মাঝে পার্থক্য কী? প্রকাশিত আর অপ্রকাশিত? হতে পারে। আমি তাই ভাবি।

আমার সামাজিকতার দক্ষতা প্রায় শূন্যের কোঠায়। অধিকাংশ মানুষের সাথে মিশতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি। তবে অল্প কথাতেই বেশ বন্ধুতা গড়ে ওঠে। কিন্তু মাঝে কেমন একটা দেয়াল উঠে যায়। ফলে, ১০০ জনের মাঝে ৯৯ জনের সাথে সম্পর্ক মাঝামাঝি প্রকৃতির হলেও সত্যিকার অর্থে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে না। দশ বছর একসাথে চেনা পরিচিত মানুষের সাথেও যেমন সম্পর্ক, দু মিনিট আগে একটু কথাবার্তা বলা মানুষের সাথেও তেমন সম্পর্ক। দেয়ালটা কেউ টপকাতে পারে না। একজন ছাড়া কাউকেই দেখলাম না টপকাতে পারতে।

না পারাই ভালো। আমার মাঝে নিষ্ঠুর এক হৃদয়হীন মানুষের বাস। সেধে পড়ে নিষ্ঠুরতায় আহত হতে দিতে চাই না কাউকে।

সময় বয়ে যাচ্ছে দ্রুত। সেদিন মাত্র কলেজের আঙ্গিনায় পা রাখলাম, আর দিনকয়েক আগে শেষ ক্লাস করে এলাম। অনুভূতি নেই। দশ বছর কাটিয়ে আসা উদয়নের জন্যে কোনো অনুভূতি হয় না, আর দেড় বছরের এই কলেজের জন্যেই বা কেন হবে? তবে হ্যা, ম আদ্যাক্ষরের মেয়েটা সত্যিকার বন্ধু হয়ে উঠতে পারত। তবে আমি কি না নিতান্তই একঘেয়ে প্রকৃতির মানুষ। বইপত্রে ডুবে থাকি। প্রাচীরটা অভেদ্য হয়ে ওঠে ক্রমশ।

আর লিখতে ইচ্ছে করছে না। এখানেই শেষ হোক।

আহনাফের জন্যে ফেসবুকে একটা ইভেন্ট খোলা হয়েছে। লিঙ্ক- https://www.facebook.com/events/550476628354796/

তুচ্ছ শব্দমালা



শব্দের চোখে করাঘাত করি ক্রোধে,
জাগাই দিনের ধূসর প্রতিচ্ছবি ।
না-পাওয়া মুখের মুখর সুষমা দিয়ে,
তবুও তোমার ছলনা-আহত কবি
তোমাকেই লেখে, তোমাকেই রচে প্রিয় !
-আক্রোশ/নির্মলেন্দু গুণ

কে জানে কেন আমরা শত আঘাতেও প্রিয় মানুষদের দৃষ্টিসীমায় রাখতেই ভালোবাসি! আমি তো রাখিনি কখনও। এতখানি মায়া আমার মাঝে জমা ছিল, আমি নিজেই কি জানতাম? জানতাম না। কেউ কেউ মায়াটুকু চাপা দিতে জানে। জানে প্রয়োজনমত নিষ্ঠুর হতে। কই, আমি তো পারি না। শিখতে চাইছি, কিন্তু পারি না যে। হায়, কি বিধ্বংসী এই মায়া!

সামনের মাসেই টেস্ট পরীক্ষা শুরু হয়ে যাচ্ছে। প্রায় মাস দুয়েক দুশ্চিন্তা আর অস্থিরতায় কাতর করে রাখবে আমাকে। তার মাঝে হয়ত হুটহাট করে একা একা পালিয়ে যাবার ইচ্ছেটা উঁকি দেবে। বইখাতার স্তূপে মুখ গুঁজে ভাববো কংক্রিটের শহর ছেড়ে পালাচ্ছি। উড়ে পালাচ্ছি। দূরে পালাচ্ছি। অনেক দূরে। কেউ জানবে না। খুঁজে পাবে না। কখনও।

“দিন শেষে দেখি পদ্মের মৃণালে শুধু মৃত্যু ফুটে আছে”
– পদ্ম মৃত্যু/ নির্মলেন্দু গুণ

আমি চুপ করে যাই। নামগুলো একে একে জমা রাখি। খুঁজে পেলে, আর কাউকে দেবো। না পেলে জমা থাকবে। সবকিছু বিলিয়ে দিতে নেই।

ক্লাসওয়ার্ক করতে গিয়ে Phrase and idioms এ পেলাম A Utopian scheme. অর্থটুকু জানা ছিল না, তবে অনুমান করতে পারছিলাম। না পারার কারণ নেই। আমি নিজেই ঘুরে বেড়াই অবাস্তব জগতে। সারাক্ষণ।

আজকাল আর লিখতেও ভালো লাগে না। এক শুভাকাঙ্ক্ষী বলেছিলেন পোর্ট্রেইট নিয়ে কাজ করতে। ভাবনাটা যে মাথায় আগে আসেনি তা নয়। এসেছিল, কিন্তু তুলবার উপায় পাচ্ছিলাম না। ছবি তুলি নিতান্তই লুকিয়ে, কেবলই মানুষের হাসির পাত্রী হবার ভাবনা কুরে কুরে খায় আমায়। এক হাতে নিজের অর্ধ-ক্ষতবিক্ষত মুখের ছবি তুলে একটু বাক্য যোগ করে হয়ত ছবি বলে চালিয়ে দিতে পারতাম। যেমন করে এই অখাদ্য বিষাদ-অস্থিরতামাখা লেখাগুলো ‘লেখা’ বলে চালিয়ে দিই।

আশেপাশের মানুষজনকে দেখে ভীষণ তুচ্ছ লাগে নিজেকে। চমৎকার সব ছবি তুলছে, চমৎকার সব লেখা সাজিয়ে তুলছে অন্তর্জালে। আমি যে কিছুই পারি না। কিছুই হয়ে ওঠে না। তিথী’পুর লেখা পড়লাম। কি অসম্ভব সুন্দর লেখে মানুষটা। “”রূপবতী, গুণবতী হয়ে আরেকবার জন্মানোর আমার বেজায় শখ”- কেমন করে মনের কথা অনায়াসে লিখে ফেলে! মানুষ নিজেই প্রায়শ জানে না নিজেকে। যেমন আমি জানি না আমার তুচ্ছতার মাত্রা কতখানি।


বিষাদের চাদরে আগাগোড়া মোড়া হয়ে যাচ্ছে জীবন। তবুও বেঁচে থাকা। আমার প্রিয় গানটার মত, ‘ All I can do is keep breathing’। এর ফাঁকে ফাঁকে সাজিয়ে নেওয়া কিছু আনন্দকণা, কিছু মায়ার ফোঁটা। কিছু দীর্ঘশ্বাস, কিছু স্বস্তি। ব্যস, এই তো চলছে। এভাবেই।

রাত্রিকালীন চিরকুট


প্রায় পুরো সপ্তাহই ক্লাস করলাম। ক্লাসের বিরক্তি কাটাতে আর সময়টা কাটাতে টিচারের চোখ এড়িয়ে প্র্যাকটিক্যাল লিখলাম লুকিয়ে লুকিয়ে। তৃতীয় দিন কাজ শেষ করে এত ক্লান্ত লাগছিল ব্যাগের ওপর মাথা রেখে আধঘুমে কাটিয়ে দিলাম প্রায় এক ঘণ্টা। আধঘুম বললাম যে মাঝেমধ্যে আধো আধো স্বপ্ন দেখছিলাম, আর সেসব স্বপ্নের অনুভূতিগুলো যে আমার মুখে ফুটে উঠছিল, সেটা টের পাচ্ছিলাম নিজেই। বারবার ঘুম তাড়িয়ে আবার নতুন করে ঘুম পাড়িয়ে নিলাম নিজেকে। বাসায় এসে ফ্রেশ হয়েও সেই আধো ঘুম। উপায় নেই যে। ম্যাথ আর কেমিস্ট্রির টিচারদের তাড়ায় পড়তে হবে।

Keith Urban এর গান শুনি। অদ্ভুত এক মায়া ছেলেটার গলায়, অদ্ভুত রকম এক আনন্দ। তার বিপরীতটা লাগে Greg Laswell এর গানে। তার গলায় বিষাদগুলো ফুটে ওঠে নিখাদ কারুকাজে। Poets of the fall শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে গেছি। Maroon 5 শুনতে চেষ্টা করেছিলাম কিছুদিন। দু একটা গান ছাড়া বিশেষ তেমন কিছু ভালো লাগেনি।

আপাতত বাজছে Brad Paisley এর She’s everything. গানের কিছু লাইন তুলে দিই, বিষাদজাগানিয়া শব্দমালার প্রতি আমার আকর্ষণ আজীবনের…

And she’s everything I ever wanted
And everything I need
I talk about her, I go on and on and on
‘Cause she’s everything to me

এত পরিপূর্ণ কেউ কি হয়? জানা নেই। আমি পরিপূর্ণ নই, বরং ঘুরিয়ে বলা যেতে পারে, আমি ভয়াবহভাবে শূন্য। রূপ-গুণের কিছুই পাইনি, কেবল কিছু এলোমেলো অনুভূতি নিয়ে ঘুরে বেড়াই এদিক সেদিক…

ন কে বলছিলাম আরেকটু বড় হলে চুপ করে পালিয়ে যাবো একা একাই। সেসব নিয়ে লম্বা চওড়া আলোচনা হল। অবাস্তব কল্পনার রাজ্যে বিচরণ করলাম অনেকটা সময়। বাস্তবের থেকে অনেক চমৎকার লাগছিল। সত্যিই, একদিন পালাতে ইচ্ছে করে। সব ছেড়ে। এই যে, আবারও অবাস্তব কল্পনার রাজ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি।

এখন বাজছে Brad Paisley এর Remind me. প্রায় ফুল ভল্যুমে। কথোপকথনের মত করে গানটা গড়া। তিনটে লাইন দিই,

Now we keep saying that we’re okay
But I don’t want to settle for good not great
I miss the way that it felt back then I wanna feel that way again

কিছু কিছু অনুভূতিকে মাঝেমাঝে এত প্রচণ্ডভাবে মিস করি, তখন মনে হয়, আগে যদি জানা থাকতো এই অনুভূতিটা তখনই আমার শেষ পাওয়া, ন্যানোসেকেণ্ড পর্যন্ত সেটাকে অনুভব করতে চেষ্টা করতাম।

কত কিছু করা হয়নি জীবনে। বয়স বাড়ছে ক্রমান্বয়ে, যদিও প্রায় কুঁড়িতেই আছি। তবুও মজা লাগে মানুষজনের প্রশ্ন শুনে। পাপার অফিসের বারোটা পেপারওয়েট কিনতে গিয়ে বিক্রেতা প্রশ্ন করে বসে, ‘আপুর অফিস কোথায়?” জীবন শেষ হয়ে যায়নি জানি, তবুও মনে হয় এই বুঝি শেষ। কবে শেষ হবে জানি না, তবু একরাশ আফসোস নিয়ে বেঁচে থাকা। কতকিছু করিনি জীবনে! সমুদ্র দেখিনি, পাহাড়ের বুকে সবুজ দেখিনি, মেঘ ছুঁইনি। কেন যেন এসবের প্রতি এখন আর আকর্ষণ বোধ করি না। চুপচাপ ঘুমোতেই ভালো লাগে।

আপাতত আবার ঘুমোতে যাই। এক মগ কফি খেয়ে বসেছিলাম ঘুম তাড়ানোর আকাঙ্ক্ষায়। বিষাদের রাতে ঘুমের সাথে লুকোচুরি খেলতে ভালো লাগে না।

শুভ হোক রাত্রি। হোক সে বিষাদের, বা আনন্দের। বা অকারণ স্বার্থপরতার।

“All I Can Do Is Keep Breathing”


একটা দিনলিপি লিখছি। বিষাদের দিনলিপি।

বিষাদে নুইয়ে পড়ার দিন চলছে ক’দিন ধরে। চুপচাপ তাকে বালিশ চাপা দিচ্ছি। কখনও ড্রয়ারে বইখাতার ভাঁজে ঘুম পাড়িয়ে দিচ্ছি। বইখাতার ভাঁজ ওল্টাতেই আমার ঘুমন্ত গোলাপ টুপ করে লাফ দিলো নিচে। তার ঘুম জীবন ভালো লাগছে না আর হয়ত। ছাদের রৌদ্র বাতাসে ঝরতেই হয়ত তার আনন্দ ছিল। আমি ভালোবেসে তাকে আটকে রেখেছি কাগজের ভাঁজে।
এমনি করে ভালোবেসে আটকে রাখতে চাই কত মানুষকে! তারা নেহাৎই তাকে আপদ মনে করে পালিয়ে যায়। ছুটতে থাকে দূর দূরান্তরে। আমি শূন্য পড়ে রই। সব হারিয়ে।

“ভালোবেসে যাকে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে…”।– নির্মলেন্দু গুণ

বেশ, তারা যাক। নীড়ের পাখি নীড়ে ফিরলে কিছু বলবার নেই। তাদের আটকে রাখাই অন্যায়। কেবল মনকে বোঝানোই দায়।

কবে যেন কার সাথে কথা হচ্ছিল ক্রোধ বিষয়ে। বলা বাহুল্য, আমার মাত্রাছাড়া ক্রোধ। যাদের একান্তই প্রাণাধিক ভালোবাসি, তারা জানে এ ক্রোধের মাত্রা। আমার যুক্তি ক্রোধান্বিত মানুষ দু’প্রকার। এক, যারা ক্রোধটা মনেই চেপে রাখে, ওপরে ফুটিয়ে রাখে হাসি। দুই, যারা ক্রোধের বিস্ফোরণ ঘটায় মুহূর্তে।

আমি দ্বিতীয় প্রকারের মানুষ। গুণাবলিতেও দ্বিতীয় শ্রেণীর, দোষেও দ্বিতীয় শ্রেণীর। কিছুতেই আর প্রথম হতে পারলাম না।

নিজের সাফাই গাইছি না, তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে দ্বিতীয় শ্রেণীর এই মানুষগুলোকেই পছন্দ করি। ক্রোধের তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণ ঘটে বলে মনের সব ক্রোধের স্ফূরণ ঘটে মুহূর্তে। অভিযোগগুলো প্রকাশিত হয়ে পড়ে। দেয়ালে তার ছায়া পড়ে। ছায়ার আকৃতিটা ভালোবাসার। নিঃসীম ভালোবাসার। তবে ওতে অভিযোগগুলোর খণ্ডন করা যায় তখনই। ভুলগুলো শুধরে দেয়া যায়। সম্পর্ক স্পষ্ট থাকে, স্বচ্ছ জলের মত থাকে প্রবাহমান।

কেউ কেউ বক্র হাসি দিচ্ছে জানি। কী আর করতে পারি!

এত এত অনুভূতি, এত এত বিষাদ। জমা রাখবার আর জায়গা হচ্ছে না মনের কুঠুরিতে। একটু একটু করে কাঠপুতুলের ঘরে ছড়িয়ে দিই। কাঠপুতুলের নির্ঘুম রাত কাটুক।

মাঝেমাঝে মনে হয় কী করলাম জীবনে? স্রেফ পরীক্ষার খাতায় কলম চালালাম, আর বইপত্রে ঘ্রাণ নিলাম নিঃশ্বাসে। কেবলই ছুটলাম দশে দশের পেছনে। এটা জীবন? একে তুমি জীবন বলো কাঠপুতুল?

মাঝেমাঝে নিজেকে নিয়ন্ত্রণছাড়া হতে দিয়েছি। তবু কিসে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা আমি। ছুটে যেতে পারি না, কেবলই হোঁচট খেয়ে পড়ি। মেঘেরা হাসে। বলে, এ জীবন তোমার জন্যে নয়।
কেউ কেউ শুধু পুড়বার জন্যে আর হোঁচট খাবার জন্যেই জন্মায় হয়ত। যেমন আমি কেবলই বিষাদঅনলে দগ্ধ হই, আর ছুটে যেতে চেয়ে হোঁচট খেয়ে পড়ি শেকল বাঁধা পায়ে। মুক্তির স্বাধীনতার স্বাদ আমার জন্যে নেহাতই তিক্ত।

তবু বেঁচে থাকা। ইনগ্রিডের গানটার মত।

The storm is coming but I don’t mind
People are dying, I close my blinds
All that I know is I’m breathing now
All I can do is keep breathing
All we can do is keep breathing”

এই গানটাকে আমার থিম সং করে নিলাম। গানের কথাগুলোর মত করে বেঁচে আছি আমি। একটু সংশোধন, হয়ত নেই, কিন্তু শিখে নিতে হবে। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। হয়ত এ নেহাৎই কৈশোর থেকে তারুণ্যে পদার্পণের সময়কালীন সাময়িক আবেগের ঘনঘটা, আত্মহত্যা প্রবণতার মত কিছু, তবুও মাঝেমধ্যে মনে হয় ২৫ ডিসেম্বর সব শেষ হয়ে গেলেই বেশ হতো। আমার আর কিছুই, কিছুই ভালো লাগছে না।

শুধু এই বইখাতা আর বিষাদের স্পর্শ আর ঘ্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকার কোনো মানে হয়? মানে আছে কোনো?

আকাঙ্ক্ষা


একটা সারাদিন কিছুই করবনা আমরা,
না কিছুই না।।

হয়তো সারাটাদিন আমরা পাশাপাশি
বসে থাকব,অনন্তকালের মতো ।।

হয়তো আবার একাও থাকবো,
কিন্তু সত্যি বলছি একটা সম্পূর্ণ দিন আমরা কিছুই
করবনা।।এই হেমন্তে যে নদী মৃত্যুর প্রস্তুতি নেবে
আগামী শীতের,তার মতো আমরাও প্রস্তুত হবো
আমাদের একটা সারাদিনের জন্যে, এই হেমন্তে।।

কে জানে বলো;
আগামী শীতে হয়তো আমরা থাকবনা।।

নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটা পেলাম নিউজ ফিডে। কেন যেন সবকিছুতেই তোমার ছায়া পড়ে। মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে প্রাপ্য সময়টুকু না পেয়ে ভাবি, কোনো একদিন সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি আমাকে নিরাশ করবে না। নেহাৎ অভিমানের কিছু শব্দাবলি মনের এ কোণ থেকে ও কোণ ঘুরে বেড়ায়। এলোমেলো শব্দাবলি সব। এরপর থেকে হয়ত এই কবিতাটা আওড়াবো। অভিমানের কবিতা। কবিতার শিরোনামটা জানা নেই…আমি নাম দিলাম অভিমানের কবিতা।

‘প্রাপ্য’ শব্দেরও কিছু শ্রেণীভেদ আছে। আমার কাছে যেটা প্রাপ্য, সেটা হয়ত অন্য কারও কাছে প্রদেয় না-ও হতে পারে। কিংবা অন্যের কাছে যা আকাঙ্ক্ষিত নয়, সেটা আমি তাকে জোর করে দিতেও পারি। প্রশ্ন হল, আমি কী চাই?

সময়, সময় এবং সময়! সবচে দুর্লভ জিনিসটাই আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।

হৃদয় রেখা ও অন্যান্য



খুব ছোটবেলায় একবার বরিশাল থেকে ফিরবার সময় বাবার প্রবল আগ্রহে এক গণকের কাছে হাত দেখিয়েছিলাম। ভদ্রলোক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ছিলেন। আধপাকা ঘর, হলুদ টিমটিমে একটা বাতি জ্বলছিল, দেয়ালে যীশুখ্রিস্টের ছবি টাঙানো। বেশ কয়েকটা ছবি। কোনোটায় যীশু ক্রুশবিদ্ধ, কোনটায় মেরী, কোনটায় যীশু হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন। আমি খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে, বসে বসে কেবল এদিক সেদিক মাথা ঘোরাই আর চারদিকে যীশুর ছবি দেখে দেখে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা চশমা চোখে শুভ্র চুলের ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি অপরিচিত কাউকেই সহ্য করতে পারতাম না। শক্ত করে বাবার হাত আঁকড়ে ধরে রাখলাম।
প্রথমে ভদ্রলোক বাবার হাত দেখলেন, তারপর আম্মুর। কী বলেছিলেন সেসব মনে নেই। এরপরে এলো আমার পালা। নিজের ব্যাপার সবাই-ই খুব গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখে। আমার আবছা করে একটা দৃশ্য মনে পড়ে শুধু। আবছা হলুদ আলোয় ভদ্রলোক আমার হাত ধরে একটা ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “হৃদয় রেখা অত্যন্ত সুন্দর!” ব্যস, আমার আর কিছু মনে নেই।

হাত দেখা সম্পর্কে আমার স্মৃতি আপাতত এটুকুই। আমার মনে পড়ে না ভদ্রলোক আমার অশেষ দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন কি না। হৃদয় রেখা কিভাবে সুন্দর হয়, তাও জানা নেই। তবে ভদ্রলোক জানতেন না, তিনি কতখানি ভুল একটা পাঠ দিয়েছিলেন।

হাত দেখা সম্পর্কে দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা এবং বলা চলে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার কাজিনের সাথে। আমরা তখনও তিনতলায় থাকতাম। তিনতলার সিঁড়িটা আমাদের দখলেই ছিল তখনও। প্রায় সময়েই তিনতলার সিঁড়ির সবচে নিচ থেকে তিন ধাপ উপরে থেকে লাফিয়ে পড়া ছিল আমাদের সবচে মজার খেলা। আমি বরাবরই ভীতু প্রকৃতির ছিলাম। আমি যখন নতুন নতুন এই বাড়িতে আসি, তখন তারা নকল দাঁত পড়ে ড্রাকুলা সেজে আমাকে ভয় দেখাতো। আমি আগে তেমন কোনো বাচ্চার সাথে মিশিনি, বড়দের সাথে সাথে আদরে মিশে থেকেছি সবসময়। কাজেই এসব দুষ্টুমিও জানতাম না।

যাহোক, একদিন সিঁড়িতে বসে আমার ফুফাতো বোন হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে এ্যাঞ্জেলাকে বলল, ‘তোমার হাতটা দাও তো!’ এ্যাঞ্জেলা এ্যারিন আপুর খুব ভক্ত ছিল। বিনা দ্বিধায় তার হাত এগিয়ে দিলো। সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার হৃদয় রেখা খুব ছোট!” তারপরে আমার হাতটা টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে চুপ করে থাকলো। এ্যাঞ্জেলা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো, “এ্যালানারটায় কী আছে?” এ্যারিন আপু বলল, “এ্যালানারটা সবচে বড়!” আমি বরাবরই কথা কম বলতাম। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা ক্যামনে বুঝে?” এ্যারিন আপু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাঁ হাতের উপরের দিকে ডান পাশ থেকে তর্জনী ছোঁয়া রেখাটা দেখিয়ে বলল, “এই দাগটা যার যত লম্বা, সে ততো ভালো, তার হৃদয় ততখানি সুন্দর!” আমি মহাখুশি!

এখনও যখনই ঘটনাটা মনে পড়ে অবচেতনে নিজের বাঁ হাতের তর্জনী ছোঁয়া রেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি। আগের মতই আছে তো? শৈশবের নিষ্পাপ মনটাকে কোথায় ফেলে এসেছি কে জানে! কত দ্রুত আমরা বদলে যাই, বছর দশেক পরে আর নিজেদের চিনতে পারি না। আমাদের হৃদয় রেখা ক্রমশ সংকীর্ণ হতে থাকে, সংক্ষিপ্ত হতে থাকে।


চিনতে পারা প্রসঙ্গে হঠাৎ ‘স’ এর কথা মনে পড়লো। অনেকদিন পরে ‘স’ সেদিন ফোন দিলো। মেয়েটা কদাচিৎ ফোন দেয়, সেলফোনের খরচ খুব বেশি লাগে আমাদের। এক ঘণ্টার কমে উঠতে পারি না। অনেক অনেক খবর পেলাম। ‘ঝ’ রিইউনিয়নের ৭০ জনের টাকা নিয়ে এখন বলে রিইউনিয়ন হবে না। রূপসী মেয়েদের পড়ালেখার প্রয়োজন নেই, ইন্টার পাস হলেই ভারি ব্যালান্সের কোনো ছেলে দেখে বিয়ে করে নেবে। প্রয়োজন আমাদের মত মিডল ক্লাস মেয়েদের, যারা কারোও উপরই নির্ভরশীল থাকতে চাইনা। ‘ফ’ এখন ক্লাস বাঙ্ক দেয়, গ্রুপিং করে, যে কি না আমাদের সেকশানে ফার্স্ট গার্ল ছিল। ‘সা’ হলিক্রসে ফার্স্ট সেমিস্টারে ফেইল করে ফাইনালে তেরোতম হয়েছে। ‘মৃ’ রাইফেলসে মেয়েদের মধ্যে সিক্সথ। ‘তা’ সেলফোন না থাকায় ‘স’ কে খোঁটা দেয়। তার মতে কষ্ট করে পড়াশুনা করে কোথাও চান্স না পাওয়ার চেয়ে ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ করে প্রাইভেটে পড়া ভালো। ‘সা’ আর ‘রা’ এর রিলেশনশিপ ভেঙে ফেলছে ‘রা’, তার পক্ষে গোঁড়াধার্মিক কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখা সম্ভব না। ‘ক’ আর ‘দী’ এর রিলেশন ভেঙে গেছে বলে ‘দী’ কলেজ চেঞ্জ করে ফেলেছে, ‘ক’ পড়াশুনা করে না আর, মাসের পর মাস এ্যাবসেন্ট। এই মেয়েটা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল একসময়, তার ভাঙা অবস্থা থেকে আমি টেনে তুলেছিলাম একদিন। ফাইভে রোল ছয় ছিল। এখন আর তাকে খুঁজে পায় না কেউ।

সবকিছুর শেষে ‘স’ এর উক্তি, একমাত্র আমি আর ‘স’ একইরকম আছি। ফোন দিলেও আমাদের গল্পহীন রাজ্যে এত এত গল্প বলে আর শেষ করতে পারি না। মাঝেমাঝে কিছু সম্পর্কের কোনো বিশেষণের দরকার হয় না। অনেক দূরের বন্ধুত্বের পেছনেও অনেক গভীরতা আর নির্ভরতা থাকে। তবে অদ্ভুত লাগে এটা ভেবেই, মাত্র এক বছর হল আমরা সবাই উদয়ন থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছি, তার মাঝেও কত পরিবর্তন। বছর দশেক পরে কি কেউ কাউকে চিনতেও পারব?

কে জানে! তবে যে যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। ‘স’ এর ভাষায়, যার যেদিকে মন, সেদিকেই সে যাক!


আজকাল ভীষণ অস্থির লাগে। অনেক জরুরি জিনিস মনে রাখতে পারি না। নীল অপরাজিতার কথাও ভুলে যাই অনায়াসেই। সেটা এই অস্থিরতার জন্যে, ‘ভুলে যাব’- সেই বিশ্বাসের জন্যেই।

আহ, সত্যিই যদি এমন হত, ‘ভুলে যাব’ বলে এক নিমিষে ভুলে যেতে পারতাম সব বিষাদের ক্ষণগুলো, স্মৃতি থেকে লুপ্ত করে দিতে পারতাম সব অনাহুত মুহূর্তগুলো!


গত সপ্তাহে আমাদের এক সহপাঠিনী আত্মহত্যা করে পৃথিবীর সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। আমি মেয়েটাকে চিনতাম না। পরদিন শুনেছি আমাদের মাঝের একজন উড়াল দিয়েছে সীমানা পেরিয়ে। আমি তার নামটাও জানি না। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় খানিক বিস্ময় উঁকি দিয়ে গেছিল। তবে এক্সামের চিন্তায় সেসবকে পাত্তা দেবার সুযোগ পাইনি।

মেয়েটার অনুভূতি পরবর্তীতে ভীষণভাবে আক্রান্ত করেছিল আমাকে। একটা মানুষ কতখানি একা, আর কতখানি নিঃসঙ্গ হলে পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দেবার কথা ভাবতে পারে? আমার জানা নেই। আমি আত্মহত্যা করবার মত সাহসী নই। Rowling যতই বলুন, মৃত্যু ঘুমিয়ে পড়ার চেয়েও সহজ আর দ্রুত একটা প্রক্রিয়া, আমি তাতে সন্তুষ্ট নই। কোনোদিন যদি যেতে বাধ্য হই, “আক্ষরিক অর্থেই” সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে যাবো। একদিন বদলে দেবো সব হিসেব নিকেশ।

“মধুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;
মৃত্যু হয়ে একদিন মিশে যাবো বিষে ।“
-নির্মলেন্দু গুণ

এইসব ব্যস্ততা


ছোটখাট কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। অভিমান কিংবা নেহাৎ জমা থাকা কিছু বিষাদের কথা। প্রতিদিন কতশত কথা বলা হয়, শোনা হয়, বুঝতে চেষ্টা করা হয়, কিংবা কেবলই এড়িয়ে যাওয়া হয়, তার থেকে দুটো শব্দ সাজিয়ে দিতে চাই।

ফেসবুকে গতকাল একজনের বিষাদ-কণ্ঠ শুনলাম। কারণটা আমার মতই, সময় চেয়েও না পাওয়া। আমি ঠিক জানি না, সবার মাঝেই এই বিষাদটা কাজ করে কি না। করলেও তার মাত্রাভেদের ঠিক কতটুকু পার্থক্য হয় যে, ওপাশের মানুষটির এই হতাশা আমাদের স্পর্শ করে না? নাকি এটা কেবলই কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা দেবার সময়কার কিছু কুয়াশা, যা কেবলই দ্বিধান্বিত করতে চায় প্রিয় মানুষদের নিয়ে? জানা নেই! কিচ্ছু জানা নেই!

তবে আমি ভেবে নিয়েছি আমি কখনও ব্যস্ত হবো না। অবশ্য আমি ব্যস্ত হলেও কারো কিছু এসে যাবে বলে মনে হয় না। যে যখন যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে তার সহযাত্রী হতে চেয়েছি। বিনিময় চাইনি। চেয়েছিলাম শুধু বছরে অন্তত তিনটে দিন প্রশ্ন করুক, ‘কেমন আছিস?’

এসব নেহাৎই বাতুলতা। এখন বুঝি। এখন জানি, কিভাবে এড়িয়ে যেতে হয় সবকিছুকে। কিভাবে ‘না’ বলতে হয়। কিভাবে বলা যায়, ‘পারবো না’। সাথে শিখে নিয়েছি ‘দুঃখিত’ বলবার সময় কণ্ঠ কিভাবে কৃত্রিমভাবে অনুতপ্ত করে তুলতে হয়। বেঁচে থাকার জন্যে এসবের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

দুর্ঘটনার পরে প্রথমবার খুব খাটুনি গেল গত পরশু। আমার মাছবন্ধুদের ঘরবাড়ি সাজালাম নতুন করে। প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়বো সামনের কিছু দিন। ওপরের শব্দমালার সাথে ব্যতিক্রম? নাহ, প্রিয় মানুষদের জন্যে আমার সময়ের কখনই অভাব হবে না। আমি কক্ষণোও ব্যস্ত হবো না।

আগে খুব ভাবতাম এসব নিয়ে। এখন কেবলই হাওয়ায় উড়িয়ে দিই এইসব জমা থাকা বিষাদ। অবহেলার প্রত্যুত্তর দিতেও ইচ্ছে করে না। মাঝেমধ্যে কাঠপুতুলকে শোনাই। যখন খুব বেশি বিষাদ জমে যায়, তখন। ব্যস্ত মানুষদের এত কিছু শুনবার সময় কোথায়? শোনাবারও ইচ্ছে নেই…

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানের মানুষ খুব বদলে যায়। কেবল আমাদের মত কিছু বোকামানুষেরা বদলাতে পারে না। ক্ষতবিক্ষত খোলসে মুখ লুকিয়ে বদলে যাওয়াদের এই পরিবর্তনকে ভিন্নভাবে দেখতে চায়। ন’ সেদিন আমার হুটহাট ঘুমাতে যাওয়া দেখে বলে ফেলল, ‘তুই ত দিন দিন রোবোটের মত হয়ে যাচ্ছিস! যখন তখন সুইচ বন্ধ করে দিস!”

আমার চেনা পরিচিত মানুষেরাও এমন হয়ে যাচ্ছে। রোবোটের মত। প্রয়োজনের সময় মায়ার বাঁধন ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে। বাঁধনটা কি বোঝার মত বোধ হয় তাদের? আমি কবে এমন করে বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া শিখবো? কবে?

পাপে-পুণ্যে এ পৃথিবী, এই প্রাণ তারচে অধিকে ।
আমি আছি, তুমি নেই–,এইভাবে দু’জন দু’দিকে
অপসৃত; -তাই তো নশ্বর নারী কবির বিশ্বাসে,
ভালোবেসে যাকে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে…।

-নির্মলেন্দু গুণ

যাকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম, তার চোখে পড়বে কি?

‘দায়’



ছোটোবেলায় সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসের অংশটুকু পড়তে ভীষণ ভালো লাগতো। মৌর্য যুগ, পাল যুগ, গুপ্ত যুগ, সম্রাট অশোকের সময়কার কথাগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতাম প্রাচীন সেই অদেখা জগতে। ক্লাস থ্রি’তে আমাদের লাইব্রেরি থেকে বই পড়া বাধ্যতামূলক হল। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে নতুন নতুন বই আসতো। একবার অতীশ দীপঙ্করের জীবনীর একটা বই পেয়েছিলাম। জীবনী পড়তে আমার বরাবরই ভালো লাগে। থ্রি’তে টপ গ্রেডার’দের বই উপহার দিতো। আমরা সবাই পেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, শিল্পী আর লেখকদের জীবনীর বই পেয়েছিলাম। ধূসর-বেগুনী রঙের বই তিনটা এখনও সময় পেলে পড়ি। আমার ক্লাসমেটরা কখনই বইগুলো পছন্দ করেনি। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগতো। অসাধারণ মানুষগুলোর জীবনকে দেখবার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি কখনই। আগের লেখায় বলেছিলাম হয়ত, আমার জীবনের গল্প শুনতে ভালো লাগে।

সবার জীবনেরই পেছনের কিছু ইতিহাস থাকে। কারোটা তিক্ত, কারোটা মসৃণ, কারো আবার কিছু বুঝতে না বুঝতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। আমারটা কেমন ছিল?

এক হিসেবে বিচার করতে গেলে প্রতি পদে পদে শিখবার মত একটা শৈশব পেয়েছিলাম আমি। এখনও দেখা যায়, কোনো অঘটনের বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলে বুঝতে পারি ওটা আসলেই দরকার ছিল। এখন যেমন ভাবি এ্যাকসিডেন্টটা দরকার ছিল আসলেই। মানুষ চিনবার জন্যে মূলত। আর দ্বিতীয় কারণটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও দরকার ছিল। এ্যাকসিডেন্টের পরে চোয়াল এখনও অবশ, নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই বলেই চলে। তাই খুব দ্রুত বা আগের মত কথা বলতে পারি না, যেটা বিতর্কের জন্যে জরুরি। একটু সিরিয়াসভাবে করতে শুরু করেছিলাম টেনের মাঝামাঝিতে। আমার যেমন স্বভাব, নতুন কিছু নিয়ে বছরখানেক মেতে থাকা, তারপর ছুঁড়ে দেয়া। পুরোপুরি সুস্থ থাকলে হয়ত এখনও এটা নিয়েই মেতে থাকতাম, পড়াশুনো গোল্লায় যেত! ‘যা হয়, তা ভালোর জন্যেই হয়’-এই বাক্যটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। কিছুটা উপায়ান্তর নেই বলেই।

গতকাল কলেজ থেকে ফেরার পরে র’ এর ফোন। হসপিটালে দেখা হবার পরে আবার গতকাল দেখা। আধঘণ্টার সময়টা খুব চমৎকার কাটলো। শিখলাম অনেক কিছু। খ্যাতি এবং শখ, প্রকাশ-অপ্রকাশ দুটোর সম্পৃক্ততা বিষয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল, কাকে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার চারপাশের সব ব্যস্ত মানুষজন। আচমকাই দেখা আর আচমকাই নিজ থেকেই উত্তরগুলো পেয়ে গেলাম! ধর্ম-ফটোগ্রাফি-বিখ্যাত সব মানুষ-পড়াশুনো-ফিউচার সব বিষয়েই চমৎকার সব বিষয় জানলাম। আমি বাইরের মানুষের সংস্পর্শ খুব কম পাই। সিনিয়রদের আর কি! যে কারণে বাস্তবতা বিষয়ে খুব কমই জানি। কাঠপুতুল, শোপিসের বালিকা!

তবুও সৌভাগ্য যে অন্তর্জালের প্রচুর মানুষের সাথে স্বল্পপরিচয়ে প্রচুর প্রচুর শিখতে পারছি। বড় ভাই কিংবা বোনের অভাব সবসময়েই বোধ করি। সেটা প্রায় সময়েই তাদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়।

সকালে তিক্ত কিছু স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমটা ভাঙালো আম্মু। হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লাফিয়ে বিছানা ছাড়লাম। কাপড় ধুতে গিয়ে ব্লেডটা হাতে অনেকখানি বসে গেছে তালুতে। ছুটোছুটি করে প্রেশার ব্যাণ্ডেজ করে দেবার পরে কিছুটা থামলো রক্তপড়া। তবে শেষ পর্যন্ত সেলাই লাগবে মনে হচ্ছে।

আজকাল রক্ত দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। ভয়ের শিহরণ খেলে যায়। অথচ এ্যাকসিডেন্টের পরে কিন্তু সেভাবে রক্ত দেখিনি। তবুও ভয় লাগে। যেমনটা আমার ভাই ভয় পায় পানি দেখলে। পুকুরে ডুবে যাবার পরে। ভয় লাগে হসপিটালে গেলেই। হসপিটালের একটা বিশেষ গন্ধ থাকে। স্পিরিট আর ফিনাইল ধরনের একটা গন্ধ। সেটা পেলেও অস্থির লাগে।

তবুও সবকিছু মিলিয়ে জীবন চালিয়ে যেতে হয়। ছোট থেকেই পাপা কিছু কথা এতবার করে রিপিট করেছে যে প্রায় যে কোনো পরিস্থিতিতেই মাথায় সেসব ঘুরতে থাকে। জীবন থেমে থাকে না। আজ আমি না থাকলেও অন্যদের জীবন থেমে থাকবে না, কিংবা অন্য কেউ না থাকলেও আমার জীবন ‘হয়ত’ খুব বেশিদিনের জন্যে থেমে থাকবে না। কথাটা হয়ত একটু রুক্ষ শোনায়, তবুও এটাই সত্য। আমরা একে অপরকে যতই ভালোবাসি, যতই মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখি, কারোর বিদায়েই কারো জীবন বন্ধ ঘড়ির কাঁটার মত স্থবির হয়ে যাবে না। অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা আমাদের জীবন। স্থবির হতে চাওয়া জীবনকেও টেনে নিয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে। এর কোনো মানে আছে?

আমি বরং ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকি। জীবন টেনে নিয়ে যাক আমায় একটা বোঝার মত। আমার আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। সব দায়িত্ব জীবনঘড়ির। হোক সে দায়িত্ব কঠিন বা সহজ। আমি স্রেফ দায়হীন।

“সহজ আনন্দ ছিল কিসে, মনেও পড়ে না।
জীবনের দেনা শুধু বাড়ে চক্রবৃদ্ধি হারে;
শুধিতে পারি না ঋণ, বুঝি সহজ ছিল না রাত্রি,
ছিল না সহজ কোনদিন।.
-নির্মলেন্দু গুণ

‘উড়োস্বপ্ন’


শিরোনাম দিতাম ‘বসন্তদিনের গল্প’। কিন্তু এখন বর্ষা চলছে। বর্ষা? হুমম, বর্ষাই তো! এই ইটকাঠের শহরে ঋতুর পালাবদল বুঝবার উপায় একমাত্র পত্রিকা আর দেয়ালে ঝোলানো ক্যালেণ্ডার। শালিকের ডাক কিংবা পলাশের ক্রোধমাখা রক্তবর্ণ দেখবার কোনো উপায় নেই!

আর একঘণ্টা পর তিন ঘণ্টার পরীক্ষায় নামবো। কি বিচ্ছিরি বিরক্ত লাগছে, কেবল আমিই জানি। রোজ রোজ জীবনের পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত আমি, এইসব ছাইপাশ লেখাজোকা, স্মৃতির পরীক্ষা দিতে ইচ্ছে করে না।

আজকেও শুনছি “Words I couldn’t say”। ভোরে সাড়ে চারটায় ঘুম ভেঙে প্রথমেই মাথায় উঁকি দিলো পটাসিয়াম ফেরোসায়ানাইড আর নেসলার বিকারক। প্রচণ্ড বিরক্তিতে মাথা ঘোরালাম তাদের তাড়া করে সরিয়ে দিতে। উলটো এ্যামোনিয়া কেন বিজারক আর ডি ব্লক মৌল কেন রঙিন যৌগ গঠন করে, সেসবের বিবরণ এসে ছুটোছুটি খেলতে লাগলো। অগত্যা উঠে বসলাম।

ইচ্ছে করে, কোনোদিন পরীক্ষার খাতায় লিখে দিয়ে আসবো, ডি ব্লক মৌলগুলো রঙিন সব স্বপ্ন দেখে বলে রঙিন যৌগ গঠন করে, আর এ্যামোনিয়া কেবলই অন্যের সখা’কে কেড়ে নিতে চায় বলে বিজারক…

পারবো না জানি। অত সাহস আমার নেই। পরীক্ষায় বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটিয়ে ফেলেছিলাম এরকম একটা ক্লাসটেস্টেই। শেষ কেমিস্ট্রি ক্লাসটেস্টটায়। উত্তরগুলো প্রশ্নপত্রে মার্ক করে এসেছি, কিন্তু খাতায় লিখতে একদমই মনে নেই। দশটা নম্বর উড়িয়ে দিলাম বদ্ধ বাতাস আর দুশ্চিন্তামাখা রোদে…
উন্মাদ হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। স্বাপ্নিক হচ্ছি। বাস্তবতা মিশে যাচ্ছে কুয়াশায়, আর আমি ছুটছি তার পেছন পেছন, তাকে ধরতে পারবো না জেনেও।

তবে যদি কোনোদিন নিশ্চিন্ত নির্ভার আশ্রয় পাই, তখন থামিয়ে দেবো এই ছুটে যাওয়া।

পুরনো আমার সাথে এখনকার আমাকে আর মেলাতে যাই না একদমই। পুরনো আমি ছিলাম বিজয়ী একজন, এই আমি পরাজিত, চরমভাবে পরাজিত। হৃদয়ের কথায় সাড়া দিতে নেহাৎই ব্যর্থ।
মাঝেমাঝে সবকিছু ফেলে বোধহয় অতিপ্রাকৃতিক বিষয়ে বিশ্বাস রাখতে হয়। সিমন নামের সেই ছেলেটা, যে কি না এত ভয়াবহ দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে ফিরে এসেছে, যদিও ভবিষ্যতে কী হবে, তার নিশ্চয়তা নেই। আমি তাকে চিনি না, সেও আমাকে চেনে না। অন্তর্জালের একজন নিয়মিত খবরাখবর প্রকাশ করে নিজ দেয়ালে, জেনে যাই তার অফুরান প্রাণশক্তির কথা। কিছু মানুষ কি অদ্ভুত প্রাণশক্তি নিয়ে জন্মায়! মৃত্যুকে পরাজিত করে ফিরে আসে প্রাণের মানুষের কাছে।

আমার আর কিছুই করতে ভালো লাগে না। অলস সবুজ দিন কাটাতে ইচ্ছে হয় শুধু। এই ইট কাঠের শহরে সবুজ কোথায় পাবো!

“পাখির শিশুর মতো যখন প্রেমেরে ডেকে ডেকে

রাতের গুহার বুকে ভালোবেসে লুকায়েছি মুখ —
ভোরের আলোর মতো চোখের তারায় তারে দেখে!
প্রেম কি আসে নি তবু? — তবে তার ইশারা আসুক!
প্রেমকি চলিয়া যায় প্রাণেরে জলের ঢেউয়ে ছিঁড়ে!
ঢেউয়ের মতন তবু তার খোঁজে প্রাণ আসে ফিরে!”
-প্রেম/ জীবনানন্দ দাশ