p { margin-bottom: 0.08in; }
প্রত্যেকবার এক্সামের সময় অনেক কিছু গুছিয়ে রাখি। এক্সামের পর এটা করব, ওটা করব। আর দশজনের মতই করা হয় না। এক্সাম শেষের দিনটায় এসে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কম্পিউটারে কাটিয়ে দিই দীর্ঘসময়, ক্লান্তি জমা করি সর্বোচ্চ যতটুকু পারা যায় । তারপর সন্ধ্যেয় বিছানায় ঠেলে দিই নিজেকে। প্রায় একমাসের ক্লান্তি এক রাতে কাটিয়ে দিতে চেষ্টা করি। ঘুম ভাঙে মাঝরাতে। সব বইপত্র অন্তত তিনটে দিনের জন্য ড্রয়ারবন্দি করে রাখি প্রথমেই। রংতুলি নিয়ে বসি। দুটো একটা আঁচড় দিয়ে অনভ্যাসের দাসত্ব মেনে নিয়ে সরিয়ে রাখি সেগুলোও। গান শুনি। অন্ধকারে হাঁটি। জানলা দিয়ে সোডিয়াম আলোয় সাঁই–সাঁই করে ছুটে যাওয়া গাড়িগুলো দেখি। দু একটা উদ্ধতের মত বিকট শব্দে ঘুমন্ত, ক্লান্ত নগরবাসীর ঘুমে ছেদ টেনে দিতে চেষ্টা করে। আমি পুরনো বাঁশির সুরটা শুনতে চেষ্টা করি। বহুবছর ধরে এই বাঁশির সুরটা শুনে আসছি। হয়তবা কোন শ্রমজীবী মানুষের দিবারাত্রির গল্প মেশানো থাকে তাতে। আমি ইট–কাঠের স্তুপে বসে, প্রাচুর্যে দিন কাটিয়ে সেই গল্প মেশানো সুরের রহস্য উদঘাটন করতে পারি না। খানিকটা বিষণ্ণতা এসে ঘিরে নেয়। ভাবনা–চিন্তার রাজ্যে বাধাহীন পদচারণা শুরু হয়। শুরু হয় নিয়মহীন জীবনযাপন।
মাঝেমাঝে নিজের এই অনিয়ম নিয়ে ভাবি খুব। এমন তো ছিলাম না কখনও। বছর দুয়েক আগেকার নিমগ্ন ভোর কিংবা ক্লান্ত অপরাহ্ন, মৌন বিকেল, আশাজাগানিয়া রাত…কোথায় হারালো?
সময় খুব দ্রুত চলে যাচ্ছে। এখনও মনে পড়ে সেইদিনই তো তীব্র অভিমানে সবকিছু শেষ করে দিতে চেয়েছিলাম। সবাই চায়। বয়সটাই এমন। বয়সও বাড়ে খুব দ্রুত। সামিলকে দেখি বিস্ময় নিয়ে। মনে হয় মাত্র দুটো বছর পেরিয়েছে তার। ছোটবেলায় সামিলকে কোলে করে ঘুম পাড়ানো, বিকেলে খানিকক্ষণ ছাদে ওকে হাঁটানো, আঙুলে গুনতে শেখানো কিংবা কান্না থামানোর চেষ্টা। প্রচুর পেটাতাম সেই সময়। ছিলও সেইরকম দুষ্টু। ক্ষতিকরভাবে দুষ্টু। ড্রয়ারে কলমগুলো পেতাম না, স্কুলের বইতে লাল–নীল মার্কারের দাগ কিংবা অঙ্ক খাতার পাতাগুলো আড়াআড়িভাবে ছেঁড়া…। মা বারণ করত। এখন বলে, সামিল অন্য যে কারো চেয়ে আমাকে বেশি মানে। আমিও খুশি হয়ে উঠি। তার দু একটা প্রমাণ পাই, যখন সামিল তার বিচিত্র সব প্রশ্ন নিয়ে আমার কাছে হাজির হয়, স্কুল থেকে এসে টেবিলে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দেখতে পাই অপেক্ষমান কিংবা এয়ারকুলারটা আগেই অন থাকে। আপু আসবে বলে।
ভালোবাসা কি অদ্ভুত একটা জিনিস, না!? বাচ্চারা বেশিরভাগ সময় এত তীব্রভাবে এর প্রকাশ ঘটিয়ে ফেলে, লজ্জায় পড়ে যাই। ছোট্ট ছোট্ট পরী আর দেবদূত একেকজন…
বহুদিন বাদে স্কুল খুলবার জন্যে অপেক্ষা করছি। স্বীকার করতে লজ্জা নেই, নিজের স্বার্থেই। উদয়নে দীর্ঘ ১১টা বছর কাটিয়ে ফেললাম দেখতে দেখতে। মনে পড়ে সেইদিনই এলাম এখানে। প্রায়ান্ধকার দিন ছিল সেদিন। ফার্স্ট বেঞ্চটা দখল করে বসলাম। লম্বা লম্বা বেঞ্চ, বিশালাকার বোর্ড, সাজসজ্জাহীন ক্লাসরুম, “বন্ধু হবে আমার?” বলতে না পারাই বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হঠাৎই বন্ধু হয়ে যাওয়া, বছরদুয়েক পরে সেই বন্ধুত্বের পতন, নতুন বন্ধু আসা, আবার যাওয়া, আবার আসা, আবার যাওয়া……
কতগুলো দিন পেরিয়ে গেছে এভাবে। আরও অনেকদিন হয়ত এভাবেই পেরোবে। অনেক মানুষ আসবে, দু একজন থেকে যাবে, তাদের হয়ত হারিয়েও ফেলব অবহেলায়…তুবার মত।
তুবাকে আমার মনে হয়ত চাইনিজদের মত। কাঁধ পর্যন্ত স্ট্রেইট চুল, চোখে হালকা চশমা আর সবসময় মুখে লেগে থাকা হাসি। কখনই কেন যেন আমার খুব অসাধারণ মনে হয়নি মেয়েটাকে। চোখের দোষ আমার। মুক্তো ভেবে শিশিরকণাই দেখি সবসময়…
একদিন ক্লাসে এসে ভেউ ভেউ করে কাঁদছিল। সবাই জিজ্ঞেস করছিল কান্নার কারণ। আমি তখন পড়া নিয়ে ব্যস্ত। মানুষের “ঠুনকো” অনুভূতি আমাকে স্পর্শ করত না একেবারেই…
তুবা স্কুল ছেড়ে গিয়েছিল ২০০৬ এ। এ ঘটনার এক বছর পরে। দুর্ভাগ্যক্রমে জানতে পেরেছিলাম সেই বৃত্তান্ত। স্কুল ছুটির সময় তুবা কি একটা কথা বলতে চেয়েছিল, আমি বরাবরের মত তাড়ায় থাকায় আমার শোনা হয়নি, স্রেফ এড়িয়ে গিয়েছিলাম তাকে। সেই অভিমানেই তার সেই অশ্রুবর্ষণ।
এরকম করে কত সোনার মানুষকে হারিয়েছি, তার হিসেব নেই কোনো। আর কত হারাবো, তারও কি আছে হিসেব? শিশিরকণা কি স্থায়ী হয় বেশিক্ষণ? আমি যে শিশিরকণাকেই মুক্তো ভেবে ছুটি তাকে ধরে রাখতে….