সম্পর্কের শুরুতে মুহূর্তগুলো খুব ঝকঝকে থাকে, না? এই যেমন, বাড়ির কাছে নামিয়ে দেওয়ার সময় শক্ত করে একবার হাত চেপে ধরা৷ দৃষ্টিসীমা থেকে হারানো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা। একবার পেছন ফিরে, ‘আরে, যাচ্ছো না কেন?’ প্রথমবার যখন ফিরছিলাম, তার চোখই ছলছল করে উঠলো মুহূর্তেই। যাওয়ার দিন থেকে শুরু হতো অস্থিরতা, তারপরের ক’দিন শুধু ‘কেন গেলে?’ এই রাগ সামলাতে না পেরে কথায় কথায় যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া। তারপর ধীরে ধীরে রাগটুকু রূপ নিতো অপেক্ষায়। ‘আবার কবে আসবে?’ দিনদুয়েকের ছুটি মিললেই, ‘চলে এসো!’ এই ফেরা-রাগ-অপেক্ষা মিলেমিশে সাড়ে চার বছর কেটে গেলো।
শেষদিন কী হল?
ভাদ্রমাসের ঝলসানো রোদে প্রায় শূন্য ক্যাম্পাসে ফাইলগুলো হাতে ধরিয়ে দিয়ে উলটো দিকে হাঁটা শুরু করলো। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানো? কি অদ্ভুত! আমার পছন্দ করা হালকা সবুজ শার্টটাই ছিল। বহুদূর পর্যন্ত, বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। যখন হারিয়ে যাবে-যাবে, তখন আমিও হাঁটা শুরু করলাম। সমান্তরালে, বহু দূর দিয়ে। তার দৃষ্টিসীমা এতদূর নয়, জানি। তবু মনে হল, যদি উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার আমার খোঁজে ফিরে তাকায় ফেলে আসা পথে?যেমন করে ফিরে তাকাই অফিস যাবার পথে, ঘরের চাবি ফেলে এসেছি ভেবে! কিংবা স্রেফ অবহেলায়- যাকে হয়তো আমি অনুবাদ করতাম, আমার খোঁজে ফিরে তাকানো হিসেবে। হয়তো ভুল অনুবাদ, মিথ্যে বিশ্বাস- তবু সান্ত্বনা!
হেঁটে হেঁটে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, এফ আর খান হল পেরিয়ে গেলাম। রাস্তার দু’পাশে দুজন। তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। রাস্তার ওপাশে চোখ রাখতে রাখতে একবার হোঁচট খেলাম। আচ্ছা, ও হোঁচট খাচ্ছে না তো? আমি তো সবসময় কনুই ধরে রাখতাম, ‘দেখো, উঁচু’। এখন ঠিকঠাক হাঁটতে শিখে গেছে? অবশ্য তাই বা কী করে বলি? আমি তো স্রেফ পাঁচ বছরে তার পথসঙ্গী হয়ে ছিলাম। তার আগে তো নিজেই পারতো। শব্দটা যেন কী, ‘গ্লোরিফাই’, নিজেকে গ্লোরিফাই করে কী হবে? আমি কেউ নই আর..
ক’দিন ধরেই তীব্র রোদ। সাথে এলোমেলো বাতাস। উত্তুরে বাতাস ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে বোধহয়। এসেই সংঘর্ষে যাচ্ছে দখিনা বাতাসের সাথে। দুয়ের মাঝে পড়ে আমার ফুলগাছগুলো নত হয়ে যাচ্ছে। তারা নত হয়ে যেন উত্তুরে বাতাস আর দখিনা বাতাসকে বলছে, ‘থামো! থামো!!’ কেউ থামছে না। থামবে অচিরেই। গোলাপ আর মাধবীলতারা বৃথাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের কি দায় এই ক্ষুদ্র ফুলগাছেদের অনুরোধ রাখবার? আচ্ছা, আমার যে আজকে একটা সাদাগোলাপ আর একটা হলুদ রঙ্গনের চারা কেনার কথা ছিল? একা একা কখনও গাছ কিনিনি। আর কেনা হবে না..
তীব্র রোদে হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত পেরিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে চলে এলাম। শেষবারের মতো একবার ফিরে তাকালাম। হালকা সবুজ শার্ট, নীল জিনস, আর রূপালি চশমার ফ্রেম। সবগুলোই আমার পছন্দ করে দেওয়া..
আর কখনও দেখা হবে না। আর কখনও ফিরে তাকানো হবে না। কনুই চেপে সাবধান করা হবে না, ‘দেখো, উঁচু’..সবকিছুতে মরচে ধরে গেছে। আর কোথাও ফিরবার নেই..
আমার হারিয়ে যাওয়া মানুষের লিস্টে আরো একজন যুক্ত হলো। হালকা সবুজ শার্ট..মরচে ধরা হালকা সবুজ শার্ট!