শেষ


সম্পর্কের শুরুতে মুহূর্তগুলো খুব ঝকঝকে থাকে, না? এই যেমন, বাড়ির কাছে নামিয়ে দেওয়ার সময় শক্ত করে একবার হাত চেপে ধরা৷ দৃষ্টিসীমা থেকে হারানো পর্যন্ত দাঁড়িয়ে থাকা। একবার পেছন ফিরে, ‘আরে, যাচ্ছো না কেন?’ প্রথমবার যখন ফিরছিলাম, তার চোখই ছলছল করে উঠলো মুহূর্তেই। যাওয়ার দিন থেকে শুরু হতো অস্থিরতা, তারপরের ক’দিন শুধু ‘কেন গেলে?’ এই রাগ সামলাতে না পেরে কথায় কথায় যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া। তারপর ধীরে ধীরে রাগটুকু রূপ নিতো অপেক্ষায়। ‘আবার কবে আসবে?’ দিনদুয়েকের ছুটি মিললেই, ‘চলে এসো!’ এই ফেরা-রাগ-অপেক্ষা মিলেমিশে সাড়ে চার বছর কেটে গেলো।

শেষদিন কী হল?

ভাদ্রমাসের ঝলসানো রোদে প্রায় শূন্য ক্যাম্পাসে ফাইলগুলো হাতে ধরিয়ে দিয়ে উলটো দিকে হাঁটা শুরু করলো। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম, জানো? কি অদ্ভুত! আমার পছন্দ করা হালকা সবুজ শার্টটাই ছিল। বহুদূর পর্যন্ত, বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম। যখন হারিয়ে যাবে-যাবে, তখন আমিও হাঁটা শুরু করলাম। সমান্তরালে, বহু দূর দিয়ে। তার দৃষ্টিসীমা এতদূর নয়, জানি। তবু মনে হল, যদি উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টিতে একবার আমার খোঁজে ফিরে তাকায় ফেলে আসা পথে?যেমন করে ফিরে তাকাই অফিস যাবার পথে, ঘরের চাবি ফেলে এসেছি ভেবে! কিংবা স্রেফ অবহেলায়- যাকে হয়তো আমি অনুবাদ করতাম, আমার খোঁজে ফিরে তাকানো হিসেবে। হয়তো ভুল অনুবাদ, মিথ্যে বিশ্বাস- তবু সান্ত্বনা!

হেঁটে হেঁটে রেজিস্ট্রার বিল্ডিং, এফ আর খান হল পেরিয়ে গেলাম। রাস্তার দু’পাশে দুজন। তেমন ভিড়ভাট্টা নেই। রাস্তার ওপাশে চোখ রাখতে রাখতে একবার হোঁচট খেলাম। আচ্ছা, ও হোঁচট খাচ্ছে না তো? আমি তো সবসময় কনুই ধরে রাখতাম, ‘দেখো, উঁচু’। এখন ঠিকঠাক হাঁটতে শিখে গেছে? অবশ্য তাই বা কী করে বলি? আমি তো স্রেফ পাঁচ বছরে তার পথসঙ্গী হয়ে ছিলাম। তার আগে তো নিজেই পারতো। শব্দটা যেন কী, ‘গ্লোরিফাই’, নিজেকে গ্লোরিফাই করে কী হবে? আমি কেউ নই আর..

ক’দিন ধরেই তীব্র রোদ। সাথে এলোমেলো বাতাস। উত্তুরে বাতাস ধীরে ধীরে আসতে শুরু করেছে বোধহয়। এসেই সংঘর্ষে যাচ্ছে দখিনা বাতাসের সাথে। দুয়ের মাঝে পড়ে আমার ফুলগাছগুলো নত হয়ে যাচ্ছে। তারা নত হয়ে যেন উত্তুরে বাতাস আর দখিনা বাতাসকে বলছে, ‘থামো! থামো!!’ কেউ থামছে না। থামবে অচিরেই। গোলাপ আর মাধবীলতারা বৃথাই চেষ্টা করে যাচ্ছে। তাদের কি দায় এই ক্ষুদ্র ফুলগাছেদের অনুরোধ রাখবার? আচ্ছা, আমার যে আজকে একটা সাদাগোলাপ আর একটা হলুদ রঙ্গনের চারা কেনার কথা ছিল? একা একা কখনও গাছ কিনিনি। আর কেনা হবে না..

তীব্র রোদে হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেত পেরিয়ে নিউমার্কেট মোড়ে চলে এলাম। শেষবারের মতো একবার ফিরে তাকালাম। হালকা সবুজ শার্ট, নীল জিনস, আর রূপালি চশমার ফ্রেম। সবগুলোই আমার পছন্দ করে দেওয়া..

আর কখনও দেখা হবে না। আর কখনও ফিরে তাকানো হবে না। কনুই চেপে সাবধান করা হবে না, ‘দেখো, উঁচু’..সবকিছুতে মরচে ধরে গেছে। আর কোথাও ফিরবার নেই..

আমার হারিয়ে যাওয়া মানুষের লিস্টে আরো একজন যুক্ত হলো। হালকা সবুজ শার্ট..মরচে ধরা হালকা সবুজ শার্ট!

ফেব্রুয়ারি


-“০২-০২-২০, খুব সুন্দর কম্বিনেশান। সব ২ আর শূন্য।”

-সামনে আরেকটা আছে এমন। ২০-০২-২০।

-হয়েছে, আমাকে না বললেও আমার মনে থাকবে। কথাচ্ছলে মনে করাতে হবে না।

-এমন দিন বেঁচে থাকতে আর পাবো না। অথচ কী সাদাসিধে একটা দিন যাবে, অসম্পূর্ণ, অপূর্ণ; হলে হতেও পারতো প্রতিবছর পালন করার মতো একটা দিন..

-মানা করেনি তো কেউ।

এমন করে কত নীরব দীর্ঘশ্বাস হারিয়ে যায় শীতের কুয়াশায়। কোনো একদিন এই দীর্ঘশ্বাসগুলো বিকেলে চায়ের কাপের পাশে মচমচে গল্পের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়াবে- এটুকুই চাওয়া।

ধাঁধাঁ


সব মেয়েরা কীসের স্বপ্ন দেখে?

রাজপুত্র?
রাজকীয় বিয়ে? একটু ব্রিটিশ উচ্চারণ টেনে, ‘রয়্যাল ওয়েডিং!’
মান্যবরের শেরওয়ানি? রঙ মিলিয়ে প্যাস্টেল শেডের মোহে’র শাড়ি?
অরেঞ্জ ভিজুয়াল বা চিত্রগল্পের চোখে লাগা মনকাড়া ওয়েডিং ফটো আর কাপল ফটোশ্যুট?

বাকিসব ঊহ্য থাকুক।

সে কী চাইলো?

সিসিমপুরের রাজকন্যা কঙ্কাবতী হতে চাইলো।

ওইযে দ্বীপে আটকা পড়া গানওয়ালা আর রাজপুত্রকে উদ্ধার করে যে কঙ্কাবতী।

‘আসছিইইইই, আসছিইইইইই…’

কেন?

এই রাজপুত্রটি যে কঙ্কাবতীর প্রাণভোমরা, তাই। তাকে আগলে রাখতেই হবে। বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সাবধানে। যত্নে। আদরে।

প্রাণভোমরাটি তাই যখন ছুটোছুটি করে নিয়ম ভাঙতে চায়, তাকে আটকে দেওয়া হয়। শক্ত কৌটোয়। দুমদাম শব্দ হয়। কৌটো ভাঙার চেষ্টায়।

কঙ্কাবতী ভয়ে কাঁপে। যোদ্ধা রাজকন্যারাও কখনও কখনও ভয় পায়।

সেই ভয় কীভাবে কাটায়? রাজকন্যারা তো আজীবনের ভীতু।

সেই যে রাজপুত্রটি যুদ্ধ শিখিয়েছিল এককালে। তলোয়ারের ঝলকানিতে প্রায় ধাঁধা লেগে গেলে কীভাবে প্রত্যাঘাত করতে হয়। কীভাবে নুয়ে পড়লে উঠে দাঁড়াতে হয়।

কঙ্কাবতীর ইচ্ছে রাজপুত্রটি কৌটোয় থাকুক। কঙ্কাবতী সব সামলে নেবে।

কবে নেবে, তা জানে না।

এটুকুই এ গল্পের ধাঁধাঁ।

অভিযোগ


প্লেটটা ঘুরিয়ে নিতে নিতে অংশু মৃদু স্বরে বলল,

‘প্লেটে যতটুকু ঝোল দিয়েছো না, একদম ঠিক আছে। বেশি ঝোল দিয়ে পানি পানি করে পোলাও খেতে ভালো লাগে না আমার।’

আড়চোখে তাকালাম একবার। প্রায় শূন্য প্লেটের একপাশে মুরগীর হাড়ের নিচে রয়ে যাওয়া ঝোলটুকু চোখ এড়ালো না আমার।

অংশু আজকাল প্রায়ই এভাবে প্রশংসা করার চেষ্টা করে। শুনি, ভালো লাগে, কিন্তু ফাঁকফোকরগুলোও স্পষ্ট দেখতে পাই। তবুও প্রত্যুত্তরে স্মিত হাসলাম।

‘মনখারাপ কোরো না।’

অংশু দ্রুত হাতে পোলাও মাখাতে মাখাতে অস্পষ্টস্বরে কী যেন বলল।

-‘বুঝিনি।’

-‘এভাবে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছে না। আর ক’টা দিন থেকে যাও।’

-আবদার কোরো না প্লিজ। যাচ্ছি ভালোর জন্যেই..

-আর ক’টা দিন থেকে গেলে আরেকটু বেশি ভালো হত।

বিল দিয়ে নিচে নেমে এলাম আমরা। রিকশায় উঠে বললাম, ‘আসি?’ অংশু কয়েক সেকেন্ডের জন্যে শক্ত করে হাত ধরে রেখে হঠাৎই ছেড়ে দিলো।

তার চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয় না এসময়। এসময়টা আমিও ঝাপসা দেখি। অংশুর মতোই। বা তার থেকে কিছু কম বা বেশি। তবুও একবার পেছন ফিরে তাকাই।

আমি জানি, অংশু অপেক্ষা করে থাকে। এই মুহূর্তের জন্যে পেছন ফিরে তাকানোর। কিন্তু অভিমানের প্রকাশে অভিযোগ করবে না।

যেমন করে আমি জানি, ঝোল বেশি হয়ে গেছিল, তবুও অভিযোগ করবে না।

“সত্যেরে লও সহজে!”


মাঝেমধ্যে মাঝরাত্তিরে বারান্দার মেঝেতে বসে পড়ি। অক্টোবরের মাঝামাঝি, কোনোদিন কুয়াশার দেখা মেলে, কোনোদিন মেলে না। এই নয় তলা থেকে চুপচাপ অন্ধকারে বসে একে একে আলো নিভে যাওয়া শহর দেখতে দেখতে নিভন্ত আলোর মতোই বিষাদের মেঘ কাটতে থাকে ক্রমশ। একসময় উঠে যাই। মনে মনে বলি,

“ভালো মন্দ যাহাই আসুক, সত্যেরে লও সহজে!”

আজ অবশ্য নয়টার সময়েই চেয়ার নিয়ে বসে পড়েছিলাম বারান্দায়। দূরে দূরে ছোট ছোট আলোর বাক্স। বাক্সের ভেতর ছোট ছোট মানুষ। কেউ পড়ছে, কেউ লিখছে, কেউ টেবিলে মাথা গুঁজে শুয়ে আছে। ক্লান্ত মানুষ। কংক্রিটের শহরে লোহার খাঁচায় বন্দি হয়ে নিত্যদিনের কর্তব্যপালনে ক্লান্ত।

তবু তো কর্তব্য পালন করছে! আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয়, কী করছ; উত্তর দেবো, কিছু না। এতগুলো বই টেনে এনেছি, এতগুলো বই কিনেছি। টেবিলের কোণে চুপচাপ ঠেস দিয়ে বসে রয়েছে তারা। তারাও আমাকে ডাকে না, আমিও তাদের কাছে যাই না। অদ্ভুত ব্যবধান। কিম্ভূত দূরত্ব৷

সামিলের জন্মদিন আজকে। ১৬ পূর্ণ করলো। একটা শার্ট আনলাম তার জন্যে। পছন্দ হল না। রাগ দেখালাম। মনকে বললাম, “সত্যেরে লও সহজে!”

আজকাল মাঝেমধ্যে মনে হয়, বড় হয়ে এত টাকা উপার্জন করব, এত টাকা উপার্জন করব যে, কাউকে দিতেও দু’বার ভাবতে হবে না। ওই যে কথাটা, “meet two ends” ওটা স্মৃতি থেকে মুছে যাবে।

একসময় বাঁধনছাড়া হতে চাইতাম না। এখন চাই। বিকল্প রাখতে চাই। একজন ব্যস্ত হলে আরেকজন। একদল বন্ধুবান্ধব৷ হোক প্রকৃত, হোক মিথ্যে। কেউ চলে গেলেও খারাপ লাগবে না, কেউ থাকলেও অস্বস্তি বা স্বস্তিবোধ হবে না। স্রেফ সময় কাটানো।

বন্ধন শব্দটাই অদ্ভুত, না? বন্ধন থেকে ভালো কিছু পেলে বোনাস, না পেলে ক্ষতি নেই। হয়ত সম্পর্কের সংজ্ঞা এটাই হওয়া উচিত।

বহু পুরনো একজন বন্ধু। তীব্র ডিপ্রেশানে এলোমেলো হয়ে আছে। হঠাৎই যোগাযোগ কমিয়ে দিলো। বারবার জিজ্ঞেস করেও সাড়া পেলাম না। আমি আমার দিক থেকে চেষ্টার অন্ত রাখিনি। তারপর একদিন বলল, দেখা করবে। চারটায় ক্লাস, বের হয়ে জানাবে। চারটা পেরিয়ে সাতটা; আমি বাড়ির পথে পা ফেললাম।

কিংবা আরেকজন। এই তো, কিছুদিন আগেই জন্মদিন গেল৷ এ উপলক্ষে দেখা করব বলে ফোন দিলাম।

“তোকে একটু পরে ফোন দিচ্ছি।”

দেড় ঘণ্টা পর গানের মাঝে রিংটোন বেজে উঠল,

“তখন আবার এ মন জাগে,

কোনো অচেনা সংরাগে..”

আমাদের সমাজ বলে, “নারীর মন হবে সবার জন্যে উন্মুক্ত, কেউ গ্রহণ করলে তাকে সাদরে আপ্যায়ন করো, আর না করলে তাকে তারচেয়েও বেশি আন্তরিকতায় বিদায় জানাও।”

-আর আমার বিষাদ? আমার আনন্দ? আমার হতাশা?

-“সত্যেরে লও সহজে!”

ফোনের স্ক্রিনে বড় বড় করে লিখে রেখেছি কথাটা।

সত্যেরে লও সহজে!

কোনো জটিলতা আর তার সমাধানের মধ্যকার দূরত্ব স্রেফ একটা “মেনে নেওয়ার।” এটাই একমাত্র হার্ডল। পেরিয়ে গেলে তুমিই বিজয়ী। আর হোঁচট খেলে তুমি পরাজিত৷ আমার মতো।

হাসি পায়। যার জীবনটাই যাচ্ছে ভুল মানুষদের প্রায়োরিটি দিতে দিতে, তার এই বিজয়ী-বিজিতের মেডেল দিয়ে কী হবে? আমার শো-কেস তো ভুলের স্মারকে ঝকঝক করছে!

তবু চেষ্টা করে যাই। কোনো দিন, কোনো দিন হয়তো সত্যেরে সহজে নিতে পারবো।

 

প্রলাপ-৮


১.

দরজাটায় প্রায় সারারাতই শব্দ হয়।

দক্ষিণের ঘর, নয় তলায় বাতাসের প্রাবল্যে সবকিছু যেন থরথর করে কাঁপতে থাকে। পর্দাগুলোকে বেঁধে রাখতে রাখতে মনে হয়, জীবনের আবেগ কিংবা অনুভূতিগুলোকে যদি এভাবে বেঁধে রাখা যেত! আবার মাঝেমধ্যে মনে হয়, অনুভূতিকে কি বেঁধে রাখা উচিত? তাদের ধর্মই তো ছন্নছাড়া হয়ে ঘুরে বেড়ানো। মাঝেমধ্যে মাথার ভেতর এসে স্মৃতিগুলোকে নাড়াচাড়া করা। অনুভূতির রসায়নকে এলোমেলো করে দেওয়া। বেঁধে রাখলে তো যন্ত্র হয়ে যেতাম। ভালোবাসা, মায়া, স্নেহ- এসব আসত কোথা থেকে!

জীবনের প্রায় তেইশ বছর পার করে আজ কয়দিন ধরে মনে হচ্ছে, কতগুলো মানুষ জীবন থেকে হারিয়ে ফেলেছি বা হারিয়ে গেছে। যদিও জীবনের ধর্মই এই যে, পুরনো মানুষ তাদের পদচিহ্ন ফেলে জীবন থেকে হারিয়ে যাবে আর নতুন মানুষ এসে তাদেরকে প্রতিস্থাপন করবে। তবুও মাঝেমধ্যে মনে হয়, কী ক্ষতি হত, যদি পুরনো মানুষগুলোও থেকে যেত!

বিধাতা হয়ত হাসছেন আমার চিন্তাভাবনা শুনে।

মানুষ হারাবেই। এটাই স্বাভাবিক। এখনও মনে হয়, সেদিনমাত্র স্কুল শেষ হল। কলেজ শেষ হল। মেডিকেলে এলাম। মেডিকেলে শেষ বর্ষের ক্লাসও শুরু হয়ে গেল আজ। আগামী বছর নভেম্বরে মেডিকেলের একাডেমিক ক্লাসও শেষ হয়ে যাবে। অথচ সেদিন মাত্র প্রথম বর্ষের ক্লাস শুরু করলাম।

এই চার বছরে কতগুলো মানুষ হারিয়ে গেছে জীবন থেকে! হিসেব নেই। মাঝেমধ্যে জানতে ইচ্ছে করে, কেমন আছে, কোথায় আছে। ভালো আছে তো?

২.

পুরনো ডিপ্রেশান ফিরে আসছে ধীর পায়ে। সবকিছু নিয়ে এত বেশি ক্লান্ত, এত বেশি বিধ্বস্ত যে, প্রায়শই মনে হতে থাকে, মাথার পেছনে একটা সুইচ থাকতো যদি! খারাপ লাগলে সুইচটা অফ করে ঘুমিয়ে যেতাম। কাজের সময় ঘুম ভেঙে উঠতাম। কাজ শেষে আবার সুইচ অফ। চিন্তাভাবনা করতেও ভয় হয়। রিভোট্রিলে অ্যাডিক্টেড হয়ে যাচ্ছি। উপায়ান্তর পাচ্ছি না যে!

এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, সুইসাইডাল চিন্তাভাবনা আসলে কী করা উচিত? প্রত্যুত্তরে যা বলল, তা আর লিখলাম না। তেমন জরুরি কিছু না। তবে তার বুদ্ধিটা ভালো লেগেছে। একটা একটা দিন করে বেঁচে থাকা। খারাপ না। চব্বিশ ঘণ্টার দশ ঘণ্টা ঘুম, ১৪ ঘণ্টার মধ্যে ৭ ঘণ্টা ক্লাস, ৪ ঘণ্টা দাঁতে দাঁত চেপে পড়াশোনা। আর বাকি তিন ঘণ্টা?

একমনে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে থাকা। তিন ঘণ্টা শেষ হবার অপেক্ষা। এই তো। চব্বিশ ঘণ্টার হিসেব।

দুই বছর আগের কথা মনে পড়ে। ডিপ্রেসড থাকতাম। সবকিছু হারানোর ভয়ে ডিপ্রেসড থাকতাম। বিশ্বস্ততার অভাব বোধ করতাম। আন্তরিকতা আর মায়ার অনুপস্থিতিটুকু উপলব্ধি করতাম।

জীবন খুব অদ্ভুত। এখন বিশ্বস্ততা, আন্তরিকতা, মায়া, স্নেহ, ভালোবাসা- কোনোকিছুরই সামান্যতম অভাব নেই। অভাব শুধু নিশ্চয়তার। ভাগ্যের অনিশ্চয়তাকেই এখন সবচে বেশি ভয় হয়।

“দুশ্চিন্তা করে কি কিছু করতে পারবে?”

এই প্রশ্নের উত্তর আমি কীভাবে দেব? আমি তো আমার পরিপূর্ণতা নিয়ে সুখী। আমার ভীতি কেবল আমার অনিশ্চয়তা নিয়ে।  ভাগ্যের রসিকতাকেই আমার যত ভয়।

দুটো রিভোট্রিল একটা রিলাফিন নিয়ে তীব্র মাথাব্যথার সাথে ঘুমিয়েছিলাম হয়ত চারটার দিকে। বেলা বারোটার দিকে এক হাহাকারে ঘুম ভাঙলো। অসহায় এক বাবা, তার সবটুকু গলার স্বর উঁচুতে তুলে মেয়ের বিয়ের জন্যে ভিক্ষা চাইছে। এত করুণ, এত অসহায় আর্তনাদ আমি কোনোদিন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। বেলা দুটো পর্যন্ত একই আর্তনাদ মাথার ভেতরটায় সবকিছু এলোমেলো করে দিল। মানুষ কখন এত অসহায় হয়ে যায়? বিধাতা কেন মানুষকে এত অসহায় করে সৃষ্টি করলেন? কোন পাপের শাস্তি এ?

একটা জীবন পার করে দিচ্ছি ভয়ে ভয়ে। এই হয়ে যাবে, সেই হয়ে যাবে, একা হয়ে যাব, এটা হারাব, সেটা হারাব। অদ্ভুত এক আতঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকা। সিজোফ্রেনিক হয়ে যাচ্ছি কি? হয়ত শেষ বয়সে সিজোফ্রেনিক হয়ে যাব!

চাইলেই সবকিছু থেকে, যাকে ইংরেজিতে বলে, সাইন আউট, করে ফেলা যায়। ডেইলি সোপের ডায়ালগের মত বলা চলে, “I didn’t sign up for this!” কিন্তু সে তো সর্বৈব মিথ্যে! আমি নিজে নিজেকে টেনে এনেছি এই অনিশ্চয়তায়। বিশ্বস্ততার লোভে, নিখাদ আন্তরিকতা আর হিসেবহীন মায়ার আকাঙ্ক্ষায়! যার মূল্য দিচ্ছি প্রতিপদে। আতঙ্কিত একেকটা দিন কাটিয়ে তার মূল্য দিচ্ছি।

মনকে বিভিন্নভাবে ডাইভার্ট করার চেষ্টা করি। বই পড়ার অভ্যেসটা মরে গেছে, কিন্তু কেনার অভ্যেসটা মরেনি। এখনও বই কিনি। পাতা উল্টাই। পড়া হয় না। মাথার ভেতর নিউরনগুলো কি যেন কাজে ব্যস্ত। আমাকে জানায় না তারা। একান্ত গোপনীয়। ব্যর্থ হয়ে বই তুলে রাখি। কোনোদিন যদি পড়া হয়!

ইলাস্ট্রেটরের কাজ শেখার চেষ্টা করি। বেশিদূর আগায় না। সবচে প্রিয়, ইতিহাস নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করি। তাতেও নিউরনের সায় নেই। তারা ব্যস্ত। অন্য কিছু নিয়ে। এদিকে সময় দেবে না তারা।

খুব খারাপ লাগলে দুই পৃষ্ঠা লিখি। খারাপ লাগার কথা। ভালো লাগার কথা। পরিকল্পনার কথা। চিন্তাভাবনা। সবকিছুই। খুব ব্যস্ত হতে ইচ্ছে করে। ফটোগ্রাফির একটা কোর্স নামিয়েছি। ইলাস্ট্রেটরের কোর্স। ক্রিয়েটিভ রাইটিং কোর্স। কিছুই শেষমেষ করতে ইচ্ছে করে না। জমে থাকে।

আগে গল্প লিখতাম, খারাপ লাগলে। এখন গল্পও লেখা হয় না। লেখা আসে না। অসমাপ্ত প্রায় সাত আটটা গল্প পড়ে আছে। কালি ও কলমে ছোটগল্প অনলাইন সংস্করণে গত মাসে একটা গল্প নির্বাচিত হল। অদ্ভুত, আমার কেন যেন কোনো আনন্দ হল না। অবাকও হলাম না। স্রেফ আনন্দিত হবার অভিনয় করলাম।

আচ্ছা, কাঠপুতুল মানুষটাই কি মরে গেছে? জীবিত মানুষের আকাঙ্ক্ষা থাকে, স্বপ্ন থাকে, ইচ্ছে থাকে, পরিকল্পনা থাকে। কাঠপুতুলের তো কিছুই নেই। তার কিছু করতে ইচ্ছে করে না, কিছু ভালো লাগে না, একেবারে কিছুইই না। মৃত মানুষের মত। মৃত মানুষের ধীরে ধীরে পচে যাওয়া ছাড়া যেমন আর কোনো পরিণতি নেই, কাঠপুতুলও ক্রমশ একটা একটা করে দিন পার হবার অপেক্ষা করছে। স্বপ্নহীন একেকটা দিন।

অপেক্ষার দিনগুলোর শেষে কী আছে, কাঠপুতুল জানে না।

প্রলাপ-৭


মনখারাপ হলে অনলাইনে বসে বসে কোটেশান পড়ি। কার কোটেশান জানা নেই। তবে এই কোটেশানটা ভালো লাগলো।

If you focus on the hurt, you will continue to suffer. If you focus on the lesson, you will continue to grow.

সমস্যা হচ্ছে, আমরা, কিংবা আমি, আঘাতের দিকেই মনোনিবেশ করে সময় পার করে দিই। অভিজ্ঞতা নামক শিক্ষকের জন্যে আমি খুব মনোযোগী ছাত্র নই। একের পর এক এই দেয়ালে সেই দেয়ালে ধাক্কা খেয়েই ফেরত আসি। কী যেন সূত্র ছিল না রসায়নের? সেই সূত্রের মতো!

আফসোস এই যে, আমার সাইকোলজি কিংবা জীবনকে আমি কোনো সূত্রে ফেলতে পারছি না। মেডিকেল সায়েন্সের ভাষায়, এটিপিক্যাল।

হয়তো এই-ই ভালো। এই নিয়তি।  বিশাল শুভ্র সাদা বর্গক্ষেত্রের এক কোণে আমি আঁকাবাঁকা একটা রম্বসের মতো চোখের শান্তি নষ্ট করে দিতে পারি!

ফোর্থ ইয়ারের ইয়ার ফাইনাল চলে। সবকিছু মিলে পরীক্ষাটা খুব জরুরি। পড়াটাও জরুরি। পড়া বাদ দিয়ে শান্তির খোঁজে ছুটছি এদিক সেদিক। কিন্তু সেই সন্ধানে সঙ্গী হবার মানুষ কই? সবাই ব্যস্ত। জীবন নিয়ে। জীবিকা নিয়ে। অথবা তাদের নিজস্ব শান্তির খোঁজে। আমার সাথে সেই শান্তিটুকুর সংজ্ঞা আর ক্রাইটেরিয়া মেলে না। তাই আমার সঙ্গী হবার উপায় নেই।

তবে কি জানো, কাঠপুতুল, জীবনপথে মানুষের যাত্রা সবসময়েই একা। তার শান্তির সন্ধান, সুখের খোঁঁজ রাখতে হবে তাকেই। কেউ সঙ্গী হবে না তাতে। সবচে ভালোবাসার মানুষটিও নয়, রক্তের সম্পর্কের মানুষও নয়। এ এক নিঃসঙ্গ যাত্রা!

প্রায়োরিটি তাই একটা অবাস্তব শব্দ। এখানে নিজের প্রায়োরিটি হতে হবে নিজেকেই। এই যে পড়ো,

Maturity is learning to walk away from people and situations that threaten your peace of mind, self respect, values, morals & self worth.

কিন্তু ওই যে, আমি যে কোনো সংজ্ঞায় পড়ি না, ক্রাইটেরিয়ায় মিলতে পারি না। আমার তাই ম্যাচিওর হওয়া হবে না। চুপচাপ তাই এদিক সেদিক ছুটবো শান্তির খোঁঁজে।

কিন্তু কেউ কাউকে খুঁজে পাবো না!

কঙ্কাল


মমিনুল্লাহর মা মারা গেল ফজরের ঠিক পরে। পাড়াপ্রতিবেশীরা কেউই ঘুম ভেঙে উঠতে চায়নি। সারাদিন খেটেখুটে এসে শীতের সকালের আরামের ঘুমটা কেইবা নষ্ট করতে চায়! শুধু পাশের বাড়ির মোনেমের মা এসে বসে ছিল মাঝরাত থেকে। দু’একবার ঝিমুনি যে মোনেমের মায়েরও পায়নি, তা নয়। কিন্তু মমিনুল্লাহ’র মায়ের কোঁকানিতে সে ঝিমুনিতে বাধা পড়েছে বারবার। মোনেমের মায়ের কথাবার্তার ঝাঁঝ বড্ড বেশি। তবু তার দয়ার শরীর। এই বস্তিতে দাইয়ের কাজ করে সে। সন্তান জন্ম দিয়ে কচি যুবতী মেয়েগুলোর মরে যাওয়ার সময় সে একাই পাশে থাকে। কাজেই সে আজরাঈলের গন্ধ চেনে। বসে বসে দোয়াদরুদ পড়তে থাকে। যেন আজরাঈল মৃতপ্রায় মানুষটিকে নিতে গিয়ে ভুল করে তার পিছু না নেয়।
অত কথা অবশ্য মমিনুল্লাহ বোঝেনি। সে শুধু কিছুক্ষণ পরপর মায়ের কাতর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিল। মায়ের কষ্ট তার সহ্য হয় না। এই তীব্র শীতের রাতেও তাই মায়ের পুরনো ছেঁড়া চাদরটা টেনেটুনে খালি গা আড়াল করে ঘরের দরজায় হেলান দিয়ে বসে ছিল সারারাত। খানিকটা ঘুমিয়েও গেছিল কি না কে জানে! মায়ের এমন আর্তনাদ সে বহু রাতই শুনেছে। কোনোদিন কম, কোনোদিন বেশি। তবে আজ যে শেষমেষ তার এই সর্বংসহা মা যে মরেই যাবে, তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি।
কাজেই মোনেমের মা যখন তার মৃত মায়ের মাথা পর্যন্ত ছেঁড়া চাদরটা টেনে দিয়ে হাই তুলতে তুলতে বাইরে এলো, মমিনুল্লাহ ভাবলো, এবার হয়তো মা ঘুমিয়েছে। মায়ের কাছে গিয়ে শুয়ে পড়া যাবে এবার। মোনেমের মা মমিনুল্লাহর পাশে বসে কৃত্রিম একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। মমিনুল্লাহ উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের কাছে যেতে শুরু করতেই মোনেমের মা তার হাত টেনে ধরে বলল, “পাগল হইছসনি? তোর মায়ে মইরা গ্যাছে গা! কই যাস তুই!? ভিতরে আজরাঈল বইস্যা আছে অহনো!”
মমিনুল্লাহ অবাক হয়ে একবার তার চাদরে ঢাকা মায়ের দিকে, আর একবার মোনেমের মায়ের দিকে তাকায়। তার বিশ্বাস হয় না। এমন কোঁকানি তো মা প্রায়ই করে। মায়ের যে খুব অসুখ ছিল! তাই বলে মরে যাবে কেমন করে?
“তুই এইহানে ব’। আন্ধার গ্যালে আমি হাসপাতালে খবর দিমুনে। চিড়ামুড়ি আসে ঘরেতে?”
মমিনুল্লাহর তখনও ঘোর কাটেনা। ৮ বছর বয়সে অত কিছু তার বোঝারও কথা নয়। কিন্তু মা মরে গেলে যে তার দুপুরে ভাত হবে না? কী খেয়ে থাকবে সে? ভাত না খেয়ে ওই বড় আপাদের কাছে পড়তে যাবে কী করে? খিদে নিয়ে তো পড়ায় মন বসে না!
“কী কইলাম তরে? চিড়ামুড়ি কিছু আসে ঘরেতে? নিয়া আয়! প্যাটে আগুন জ্বলতাছে!!”
মমিনুল্লাহ সচকিত হয় তখন। দৌড়ে গিয়ে চৌকির নিচে রাখা ভাঙা টিনটা বের করে। চৌকির উপরে তার সদ্য মৃত মায়ের মুখটাও কি তার খুব দেখতে ইচ্ছে করে? সেজন্যে কি সে এক মুহূর্ত টিনটা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে চাদরে ঢাকা অবয়বটির দিকে? তবে আজরাঈলের ভয়েই হয়ত আর চাদরটা সরানো হয় না। দৌড়ে সে ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসে। টিনে শুকনো বিস্কুট আর চিড়ামুড়ির তীব্র সংঘর্ষের শব্দ আর মমিনুল্লাহর পায়ের শব্দ এক হয়ে যায়।
মোনেমের মা’র সারারাতের ক্লান্তি দূর হয়ে যায় টিনটা দেখে। টিন খুলে বিস্কুটে কামড় দিতে দিতে পাশে স্থবির বসে থাকা মমিনুল্লাহকে বলে, “অহন কই যাবি?”
মমিনুল্লাহ তখনও কিছু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না। বিড়বিড় করে বলে, “কই যামু?”

মোনেমের মা বিরক্ত গলায় বলে, “তরেই তো জিগাইলাম কই যাবি তুই। আমি ক্যামনে কমু?”

মমিনুল্লাহ ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, “মায়ে কি সত্যই মইরা গ্যাছে?”

মোনেমের মা এবার একটু নরম হয়, “হ রে ব্যাডা। মনখারাপ করিসনা। গরিবের আল্লা আছে। আল্লায় দ্যাখব তরে।”

মমিনুল্লাহ স্থবির বসে থাকে। তার অতটুকু মাথায় অতকিছু ঢুকতে চায় না। শুধু বোঝে, তার মা নেই। কেউ নেই। সে একা।

মোনেমের মা বিস্কুটগুলো তৃপ্তিসহকারে শেষ করে মমিনুল্লাহর ঘাড়ে হাত রেখে বলে, “পানি আন দেহি বাপ! তারপরে দেখতেছি কী করন যায়।”
মমিনুল্লাহ ধীর পায়ে হেঁটে গিয়ে পানি নিয়ে আসে। পানিটা এক নিঃশ্বাসে শেষ করে মোনেমের মা তাকে পাশে বসায়। নিচু গলায় বলে,

“তুই অহন কই যাবি ক’ দেহি?”

“জানি না খালা,” মমিনুল্লাহর গলা ধরে আসে।

“শোন তরে একটা কথা কই। কিরা কাট, কাউরে কইবি না।”

মমিনুল্লাহ কৌতূহলভরে তাকায়। কিরা কাটে।

“দ্যাখ বাপ, তর এহন কেউ নাই। মায়ে মইরা গ্যাছেগা। এই ঘরও তরে ছাইড়া দিতে হইব। ট্যাকা পাবি কই? খাওনের ট্যাকাও তো নাই। ঠিক কইছি?”

মমিনুল্লাহ মাথা নাড়ে। কেমন যেন ভয় লাগতে থাকে তার। ঘর ছাড়লে সে যাবে কোথায়?

“তরে যদি আমি এক হাজার ট্যাকা দেই, তুই এহান থিক্যা চইল্যা যাইতে পারবি? তর মায়ের দ্যাশের বাড়ি?”

সে মাথা নাড়ে। পারবে।

“আইজকা রাইতেই চইলা যাবি ট্যাকা নিয়া। আমি বাসে উডায় দিমু। কাউরে কইবিনা।”

“কিন্তু মা? মায়ে কই যাইব?”

মোনেমের মা চাপা গলায় বলে, “তর মায়েরে দাফন করতে হইব। কিন্তু এইহানে তো দাফনের ম্যালা খরচ। অত ট্যাকা পামু কই? অন্য জায়গায় দাফন করুম।”

“কই দাফন করবেন?”

“মেডিকেলে। বেওয়ারিশ বইলা মেডিকেলে নিয়া গেলে তারা সোন্দর জায়গায় দাফন দিব। তর মায়ে অনেক শান্তি পাইব।”

“কিন্তু মায়ে যে কইছিল, তারে নানীর কবরে দাফন দিতে?”

“এই লাশ নিয়া তুই যাইবি ক্যামনে? অত খরচ কেডায় দিব? তুই আমার কথা শোন। তর মায়ের ব্যবস্থা আমি করতেছি। তরে আমি রাইতেই ট্যাকা দিয়া বাসে উডায় দেই। তুই যা গা।”

মমিনুল্লাহ কী করবে ভেবে পায় না। তার আর কোনো উপায়ও নেই। অগত্যা সে রাজি হয়ে যায়।

মোনেমের মা বিজয়ীর হাসিটুকু চেপে রেখে মমিনুল্লাহর কাঁধে চাপড় দিয়ে উঠে পড়ে। তার এখন বড় কাজ। দ্রুত মেডিকেলের দিকে রওনা হয় সে। বেলা বাড়ার আগেই কাজ শেষ করতে হবে।

দরদাম করে শেষমেষ মোনেমের মা পনের হাজার টাকা হস্তগত করে। এক হাজার মমিনুল্লাহকে দেয়। সে বিশই চেয়েছিল।
কিন্তু প্রবীর ডোম সিগারেটে টান দিতে দিতে বলে,“এক ছেট কঙ্কালের দামই অহন থাট্টি ফাইব। তরে যদি বিশই দিমু,আমার লাব থাকলো কিছু?

আলো


১.
পায়ের শব্দ পেয়ে দ্রুত বুকশেলফ থেকে সরে গিয়ে ঘর থেকে বেরোতেই অংশুর সাথে ধাক্কা খেলাম। গত সাতদিনে এটা নতুন কিছু নয়। তবু অভ্যস্ত হতে সময় লাগছে।  অংশুর এক চোখ অন্ধ। গ্লুকোমায় বাঁ চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে বহুদিন আগে। অন্য চোখটায় মাত্র ৫% দেখতে পায়। অন্ধ একটা ছেলের সাথে বিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে বাবা-মার সাথে গত এক মাস ধরে আমার কোনো কথা হয় না। আমাকে জেনেশুনে ‘অন্ধকূপে’ ফেলে দেবার অভিমানটা কাটাতে পারিনি বিয়ে হয়ে যাবার পরেও।

‘স্যরি, দেখতে পাইনি’

কথাটা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালাম।

‘আমি তো জানি, তুমি দেখতে পাও না। এতে বারবার স্যরি বলার কি আছে? কিছু হলেই স্যরি, স্যরি!’

অংশু শব্দ করে হাসল। অস্বীকার করি না, অংশুর হাসিটা সুন্দর।

‘আসলে, তুমি যেমন এখনও ধাক্কা খাওয়ায় ঠিক অভ্যস্ত হতে পারোনি, আমিও নতুন একটা মানুষকে ধাক্কা দিয়ে অভ্যস্ত হতে পারছি না। সমস্যা নেই। আস্তে আস্তে দুইজনই অভ্যস্ত হয়ে যাব।’

মা’র কথা ছিল, আমাকেই বা কে বিয়ে করবে? ঠোঁটের কাছে বিশাল একটা ক্ষত আমার। বাস দুর্ঘটনায় কোণাকুনিভাবে ঠোঁট ছিঁড়ে গেছিল আমার। সে ক্ষতটা ঠিকমত সারেনি কোনোদিন। দাগটা রয়েই গেছিল। অংশু সে হিসেবে ভালো পাত্র। ছোট একটা কফিশপ চালায়। আমি একটা স্কুলে পড়াই। আমাদের দিন চলে ‘যাবার কথা।’

মাত্র সাতদিন। আমি জানি না, সাত মাসও, মা’র ভাষায়, ‘চলে যাবে’ কি না। তনয়কে আমি ভালোবাসতাম। আমাদের বিয়ে করার কথা ছিল গ্রাজুয়েশানের পর। বাস দুর্ঘটনার পরেও তনয় বহুদিন ছিল আমার সাথে। তারপর যখন ইউনিভার্সিটিতে এডমিশন নিলাম, তনয় জানালো, তার বাসায় মানবে না।

-তোমার কি এই ক্ষত নিয়ে কোনো আপত্তি আছে?
-না, কিন্তু আমার বাসায় যদি তোমাকে পছন্দ না করে?

আমি হেসে ওর হাতে ছোট্ট একটা স্পর্শ দিয়ে সেদিন রবীন্দ্র সরোবর থেকে কল্যাণপুর পর্যন্ত হেঁটে হেঁটে বাসায় এসেছিলাম। তার সাথে আমার সম্পর্ক ছিল প্রায় সাত বছর। সম্পর্ক শেষ হতে লাগল সাত মিনিট।

অংশুর অবশ্য এই ক্ষত নিয়ে অভিযোগ ছিল না। প্রথম দেখার দিন, কিংবা বিয়ে থেকে এই সাতদিন- কখনই না। দুটো বিষয় হতে পারে, এক, সে কোনোদিন এই ক্ষতটা ভালো করে খেয়াল করেনি; দুই, তার নিজের ঘাটতিটুকু সে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করেছে এ নিয়ে অভিযোগ না করে।

২.
-দেখো কিন্তু। এখানে একটু নিচু।
-ঠিক আছে।
-সাবধানে। হাত ধরো আমার।

বসন্তোৎসবে এসেছি আমরা। আমাকে কলাপাতা সবুজ একটা শাড়ি উপহার দিয়েছে অংশু। সে কিনেছে সান্ধ্য নীল একটা পাঞ্জাবি। চারুকলার পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। হাত ধরে। আমার হাত ভর্তি বেলি ফুলের মালা জড়ানো। আমরা হাত ধরেই হাঁটি সবসময়। ওর সুবিধা হয়। অবশ্য একা একাও সে ভালোই চলাফেরা করতে পারে। তবে এদিক সেদিক ধাক্কা খায় কিংবা উঁচু নিচু বুঝতে না পেরে হোঁচট খায়- এই যা!

তনয়ের অবশ্য সেসব ছিল না। তার সাথে আমার দেখাই হত বছরে একবার কি দু’বার। হাত ধরাধরি তো দূরের কথা।

-আচ্ছা, তনয়কে খুব বেশি ভালোবাসতে তুমি? আমার চেয়ে বেশি?
-অতীত অতীতই, অংশু। তনয় একটা নিভে যাওয়া প্রদীপ। একটা ছিঁড়ে ফেলা পৃষ্ঠা। সেটা টেনে তো লাভ নেই। আর মাত্র সাতদিন হল আমাদের..
-কিন্তু এই যে, তনয়ের কথা বলতেই তোমার চোখে পানি চিকচিক করছে। তনয় যে অতীত, তোমার চোখ তো তা বলে না।

আমি বিস্ময়ে অংশুর দিকে ফিরে তাকাই। তার তো এতটা দেখতে পাবার কথা নয়।

-হয়তো চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় আমার দৃষ্টিশক্তি মাত্র পাঁচ ভাগ। কিন্তু, বলতে পারো অন্তরা, ভালোবাসা দেখতে কতটুকু দৃষ্টিশক্তি লাগে? তোমার তো শুধু চোখ ভিজে আসেনি। কণ্ঠটাও সিক্ত হয়ে গেছে। এদিকে, রাস্তাটা একটু রুক্ষ হলেই তুমি শক্ত করে আমার হাত চেপে ধরো। এই যে, সেদিন লুকিয়ে বুকশেলফ থেকে আমার ডায়েরী পড়লে। ডায়েরীটা জায়গামতো রাখতে ভুলে গিয়েছিলে। ওতে লেখা ছিল, আমি রূপার ঝুমকো আর কাজল টানা চোখ ভালোবাসি। তোমার রূপার ঝুমকো নেই দেখে পাশের বাসার মেয়েটার থেকে ধার করে আনলে। গাঢ় করে কাজল দিলে। ভালোবাসো বলে?

আমি স্তব্ধ হয়ে রই।

অংশু নামের অর্থ জানো, অন্তরা?

আমি বিড়বিড় করে বলি, “আলো!”

ত্রিশ শব্দের অণুগল্প-২:: ফাগুন


-আইজকা এই ফুলগুলান বেচলে তরে ওই বাসন্তী জামাখান কিন্যা দিবাম। বুঝলি?

কনুই পর্যন্ত কাটা দু’হাতে ফুলভর্তি বালতিটা ধরে মোমেনা খুশিতে ঘাড় নাড়ে। তারও ফাগুন হবে তাহলে!

~ফাগুন~

#ত্রিশশব্দেরঅণুগল্প