‘দায়’



ছোটোবেলায় সমাজবিজ্ঞানের ইতিহাসের অংশটুকু পড়তে ভীষণ ভালো লাগতো। মৌর্য যুগ, পাল যুগ, গুপ্ত যুগ, সম্রাট অশোকের সময়কার কথাগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যেতাম প্রাচীন সেই অদেখা জগতে। ক্লাস থ্রি’তে আমাদের লাইব্রেরি থেকে বই পড়া বাধ্যতামূলক হল। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে নতুন নতুন বই আসতো। একবার অতীশ দীপঙ্করের জীবনীর একটা বই পেয়েছিলাম। জীবনী পড়তে আমার বরাবরই ভালো লাগে। থ্রি’তে টপ গ্রেডার’দের বই উপহার দিতো। আমরা সবাই পেয়েছিলাম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী, শিল্পী আর লেখকদের জীবনীর বই পেয়েছিলাম। ধূসর-বেগুনী রঙের বই তিনটা এখনও সময় পেলে পড়ি। আমার ক্লাসমেটরা কখনই বইগুলো পছন্দ করেনি। কিন্তু আমার খুব ভালো লাগতো। অসাধারণ মানুষগুলোর জীবনকে দেখবার সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি কখনই। আগের লেখায় বলেছিলাম হয়ত, আমার জীবনের গল্প শুনতে ভালো লাগে।

সবার জীবনেরই পেছনের কিছু ইতিহাস থাকে। কারোটা তিক্ত, কারোটা মসৃণ, কারো আবার কিছু বুঝতে না বুঝতেই অনেকটা সময় কেটে যায়। আমারটা কেমন ছিল?

এক হিসেবে বিচার করতে গেলে প্রতি পদে পদে শিখবার মত একটা শৈশব পেয়েছিলাম আমি। এখনও দেখা যায়, কোনো অঘটনের বেশ অনেকটা সময় কেটে গেলে বুঝতে পারি ওটা আসলেই দরকার ছিল। এখন যেমন ভাবি এ্যাকসিডেন্টটা দরকার ছিল আসলেই। মানুষ চিনবার জন্যে মূলত। আর দ্বিতীয় কারণটা খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ না হলেও দরকার ছিল। এ্যাকসিডেন্টের পরে চোয়াল এখনও অবশ, নিয়ন্ত্রণ প্রায় নেই বলেই চলে। তাই খুব দ্রুত বা আগের মত কথা বলতে পারি না, যেটা বিতর্কের জন্যে জরুরি। একটু সিরিয়াসভাবে করতে শুরু করেছিলাম টেনের মাঝামাঝিতে। আমার যেমন স্বভাব, নতুন কিছু নিয়ে বছরখানেক মেতে থাকা, তারপর ছুঁড়ে দেয়া। পুরোপুরি সুস্থ থাকলে হয়ত এখনও এটা নিয়েই মেতে থাকতাম, পড়াশুনো গোল্লায় যেত! ‘যা হয়, তা ভালোর জন্যেই হয়’-এই বাক্যটাকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছি। কিছুটা উপায়ান্তর নেই বলেই।

গতকাল কলেজ থেকে ফেরার পরে র’ এর ফোন। হসপিটালে দেখা হবার পরে আবার গতকাল দেখা। আধঘণ্টার সময়টা খুব চমৎকার কাটলো। শিখলাম অনেক কিছু। খ্যাতি এবং শখ, প্রকাশ-অপ্রকাশ দুটোর সম্পৃক্ততা বিষয়ে কিছু দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করছিল, কাকে জিজ্ঞেস করবো বুঝতে পারছিলাম না। আমার চারপাশের সব ব্যস্ত মানুষজন। আচমকাই দেখা আর আচমকাই নিজ থেকেই উত্তরগুলো পেয়ে গেলাম! ধর্ম-ফটোগ্রাফি-বিখ্যাত সব মানুষ-পড়াশুনো-ফিউচার সব বিষয়েই চমৎকার সব বিষয় জানলাম। আমি বাইরের মানুষের সংস্পর্শ খুব কম পাই। সিনিয়রদের আর কি! যে কারণে বাস্তবতা বিষয়ে খুব কমই জানি। কাঠপুতুল, শোপিসের বালিকা!

তবুও সৌভাগ্য যে অন্তর্জালের প্রচুর মানুষের সাথে স্বল্পপরিচয়ে প্রচুর প্রচুর শিখতে পারছি। বড় ভাই কিংবা বোনের অভাব সবসময়েই বোধ করি। সেটা প্রায় সময়েই তাদের দিয়ে পূর্ণ হয়ে যায়।

সকালে তিক্ত কিছু স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো। ঘুমটা ভাঙালো আম্মু। হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে। লাফিয়ে বিছানা ছাড়লাম। কাপড় ধুতে গিয়ে ব্লেডটা হাতে অনেকখানি বসে গেছে তালুতে। ছুটোছুটি করে প্রেশার ব্যাণ্ডেজ করে দেবার পরে কিছুটা থামলো রক্তপড়া। তবে শেষ পর্যন্ত সেলাই লাগবে মনে হচ্ছে।

আজকাল রক্ত দেখলেই বুক কেঁপে ওঠে। ভয়ের শিহরণ খেলে যায়। অথচ এ্যাকসিডেন্টের পরে কিন্তু সেভাবে রক্ত দেখিনি। তবুও ভয় লাগে। যেমনটা আমার ভাই ভয় পায় পানি দেখলে। পুকুরে ডুবে যাবার পরে। ভয় লাগে হসপিটালে গেলেই। হসপিটালের একটা বিশেষ গন্ধ থাকে। স্পিরিট আর ফিনাইল ধরনের একটা গন্ধ। সেটা পেলেও অস্থির লাগে।

তবুও সবকিছু মিলিয়ে জীবন চালিয়ে যেতে হয়। ছোট থেকেই পাপা কিছু কথা এতবার করে রিপিট করেছে যে প্রায় যে কোনো পরিস্থিতিতেই মাথায় সেসব ঘুরতে থাকে। জীবন থেমে থাকে না। আজ আমি না থাকলেও অন্যদের জীবন থেমে থাকবে না, কিংবা অন্য কেউ না থাকলেও আমার জীবন ‘হয়ত’ খুব বেশিদিনের জন্যে থেমে থাকবে না। কথাটা হয়ত একটু রুক্ষ শোনায়, তবুও এটাই সত্য। আমরা একে অপরকে যতই ভালোবাসি, যতই মায়ার বাঁধনে বেঁধে রাখি, কারোর বিদায়েই কারো জীবন বন্ধ ঘড়ির কাঁটার মত স্থবির হয়ে যাবে না। অদৃশ্য এক সুতোয় বাঁধা আমাদের জীবন। স্থবির হতে চাওয়া জীবনকেও টেনে নিয়ে যাবে সময়ের সাথে সাথে। এর কোনো মানে আছে?

আমি বরং ইতিহাস নিয়ে পড়ে থাকি। জীবন টেনে নিয়ে যাক আমায় একটা বোঝার মত। আমার আর কোনো দায়-দায়িত্ব নেই। সব দায়িত্ব জীবনঘড়ির। হোক সে দায়িত্ব কঠিন বা সহজ। আমি স্রেফ দায়হীন।

“সহজ আনন্দ ছিল কিসে, মনেও পড়ে না।
জীবনের দেনা শুধু বাড়ে চক্রবৃদ্ধি হারে;
শুধিতে পারি না ঋণ, বুঝি সহজ ছিল না রাত্রি,
ছিল না সহজ কোনদিন।.
-নির্মলেন্দু গুণ

2 thoughts on “‘দায়’

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান