রূপান্তর



গত এক মাস ধরে আমি ভীষণভাবে বদলে যাচ্ছি। ভীষণভাবে। বদলে যাওয়ার পরিমাণটা এত বেশি যে নিজেই হঠাৎ যখন বুঝতে পারি, আমার এমনটা করার কথা নয়, চমকে উঠি। বিস্মিত হই, ভাবি, আদৌ কি আমার মাঝে আছি কি না। নাকি অন্য কারো অস্তিত্ব এসে বিলীন হয়ে গেছে আমার মাঝে?
এই পরিবর্তিত মানুষটাকে আমি ডাকি কাঠপুতুল বলে। আমি এতদিন প্রকৃত অর্থেই মায়ামমতাহীন এক কাঠপুতুল হয়ে উঠতে চেয়েছি। বেশিরভাগ সময়েই পারিনি। মায়া বারবার ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বলেছে, “ধুৎ, এত কঠিন হলে চলে? আমি ছাড়া তুমি অর্থহীন!” ব্যস, আবার মায়া নামক অর্থহীন অস্তিত্বটাকে আপন করে ঢেলে দিয়েছি…

অভিমান, রাগ, জেদ, বিষাদ- এইসব অনুভূতিকে নেহাৎই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। সব আবেগ চাপা দিতে শিখেছি। প্রচণ্ড অভিমান হলেও হেসে ফেলে সব উড়িয়ে দিই। আমার অভিমান যে বড় বিধ্বংসী। আমাকে ধ্বংস করে দিতে চায়।


আমার ইদানিং টেলিপ্যাথি জিনিসটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। যার কথা ভাবি, সে কোনো না কোনোভাবে সামনে চলে আসে। কিংবা তার খবরটা বেশ কিছু সময় মনকে অধিকার করে থাকে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘ইচ্ছে’ সিনেমাটা খুব ভালো লেগেছিল। ‘তিতলী’ দেখেছিলাম অনেক ছোটবেলা, প্রায় মনেই নেই। মৃত্যুসংবাদটা তাকে জানাতে নেহাৎ অস্পষ্ট একটা শব্দ ছাড়া তার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে হতাশই হলাম না। কিছু কিছু মানুষ নেহাৎই অনুভূতিহীন হয়ে জন্ম নেয়। শত চেষ্টাতেও তাদের মনে অনুভূতির বীজ ডালপালা মেলে ধরতে পারে না।

কিংবা আমার ছোট্টো সাদা মাছটার কথা। তাকে আনা হয়েছিল তার আরো ন’জন বন্ধুবান্ধবসহ। দিনকয়েক কাটবার পরে তার সাথে তার বন্ধুদের খুব ঝগড়া হল। তার অভিমানটাও আমার মতো, বিধ্বংসী। ক্রোধে একে একে তার বন্ধুদের কোমল সাদা দেহ খুঁটে খুঁটে খেয়ে তার ক্রোধ মেটালো। কঙ্কালটাও খুঁজে পেলাম না। এরপরে সে শান্ত হল। আমার মতো, বহুদিন পর, সব ধ্বংস করে। আজ দুপুরে ভাবছিলাম, একা একা মাছটার বেঁচে থাকতে কষ্ট হয় না? সন্ধ্যেয় আমাকে উত্তর না দিয়েই সে নিজেকে ধ্বংস করে ফেললো তার অন্য সঙ্গীদের হাতে। মাছটার কি তখন আফসোস হচ্ছিল তার বন্ধুদের জন্যে? তীব্র অনুতাপে কি সে এতটাই দগ্ধ হচ্ছিল যে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টাই করেনি একটুও? আমি যেমনটা অনুতাপে দগ্ধ হই, কেন কিছু মানুষকে এত আপন করেছিলাম? কিন্তু নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে পারি না?


সব মানুষের জীবনেই বোধহয় কিছু স্মৃতি থাকে, যার আতঙ্কে তারা উন্মাদের মত সর্বস্ব পেছনে ফেলে কেবলই সামনে এগিয়ে যেতে চায়। একদিক থেকে বোধহয় ভালোই। নেতিবাচক অনুভূতি যদি মানুষকে ক্রমশই ধ্বংস না করে সামনের দিকে ঠেলে দিতে থাকে, তাকে নিশ্চয়ই মন্দ বলা যায় না? মনে পড়ে, এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগের দিন এক আত্মীয়ার সাথে কথা বলার সেই অসহ্য স্মৃতিটা। আমি নিজেও জানি না, কেন এতটা ভেঙে পড়েছিলাম। তার প্রায় এক বছর পর ভাবতে ভাবতে হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলাম, বছরছয়েক আগে তার পূর্বতন মানুষটিও আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন, “আমি কে? তুমি চেনো আমাকে? আমি তোমার কেউ হই?”
তখনও উত্তর দিইনি। এবারও দিইনি। উত্তর দেবার মত শক্তি অর্জন করতে আমার অনেক বছর লেগে যাবে হয়ত। কিংবা হয়ত আমি কোনোদিন এর উত্তর দিতে পারবো না।
কারণ আমি চিনি না। সত্যিই চিনি না। কেউ আমার কিছু হয় না। আমি কারও কিছু হই না। কিচ্ছু না।


কাঠপুতুলের মাঝে অনুভূতি সব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এটা অবশ্য খুব পুরনো কথা নয়। শৈশবে আমি এমন ছিলাম। মা বলত, এমনকি এখনও বলে, আমি ভীষণ কঠিন হৃদয়ের মানুষ। হয়ত আমি ভালোবাসার প্রাখর্যটা অনুভব করি না, করতে চাই না। মাঝে বছরখানেক হয়ত খানিকটা কোমলতা এসে ভর করেছিল। কাউকে যেতে দিতে ইচ্ছে করতো না, কাউকে আহত করতে ইচ্ছে করতো না, কাউকে বিষাদে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো না। এখন সব পারি। কেউ যেতে চাইলে তার যাবার পথ করে দিই, কারও আঘাতের বিনিময়ে গভীরতর আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত করি, অতল বিষাদে তার নিঃশ্বাস রোধ করে দিই। কেউ আমার কিচ্ছু না, কারও প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মায়া নেই। যেটুকু আছে, সেটা কৃত্রিম। মায়ার ধ্বংসাবশেষ জেগে উঠতে চাইছে মাত্র। তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি ক্রমশ।

কেউ আমার কিছু হয় না। আমি কারও কিছু হই না। কিচ্ছু না।

স্বীকারোক্তি


আজকে কিছু একটা লিখতে ইচ্ছে করছে। শিরোনাম দিতে ইচ্ছে করছে অনন্তদিনের গল্প।

অনন্তদিনের অর্থ খুঁজতে গেলে দিশেহারা হয়ে যেতে হবে হয়ত। ধরো, আমার বিষাদমাখা দিন হতে পারে অনন্তদিন। কিংবা এ্যাকসিডেন্টের পরে বাসায় ফেরার তাড়াটা হতে পারে অনন্তদিন। কিংবা বাসায় ফেরার পরে সুনীলের সেই সময় পড়তে পড়তে ক্লান্ত হয়ে যখন দেখতাম মাত্র রাত তিনটে বাজে, কিন্তু আমি নির্ঘুম, তাও হতে পারে অনন্তদিন। কিংবা, কিংবা ধরো, সাভারে চাপা পড়া মানুষগুলোর কাছে ওই আঁধারে ওই নরকে এক ঘণ্টাও অনন্তদিন ছিলো।

বেঁচে ওঠার পরে প্রায় সময়ে মা চুপচাপ লম্বা সময় ধরে পড়ায় মগ্ন আমার দিকে নিষ্পলক চেয়ে থাকে। আমি টের পেলে ভীষণ অস্বস্তিতে পড়ে যাই, আম্মু তখন ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাশ ফেরে। ক্ষণকাল পরে বলে ওঠে, ‘আমার কেমন যে লাগে সেই ছটফটানির দৃশ্যটা দেখলে, বুকের মধ্যে চেপে আছে এখনও’। আমি হাসি। সাভার ট্রাজেডির পর টুকরো টুকরো অসম্ভব কষ্টের কথাগুলো যখন বের হচ্ছিল, মা প্রশ্ন করত, ‘তার আত্মাটার তখন কেমন লাগছিল আল্লাহ’! রাজিব মারা যাবার পরেও একই প্রশ্ন।

সত্যিই তো, কেমন বোধ হয়? আমি এমন এক অভাগা, মৃত্যুকে ছুঁয়ে এসেও আমার কিছু মনে পড়ে না। আমার মনে পড়ে না আমার পুরো জীবনটা কি এক ঝটকায় চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল কি না। কিংবা কোনো সুড়ঙ্গের শেষে আলো দেখে তার দিকে ছুটেছিলাম কি না। সবশেষ স্মৃতি একটা সাদা কংক্রিটের ঘর, আশেপাশে সবুজ। শত চেষ্টাতেও কিছু মনে পড়ে না আর।

বোধহয় ওটা মৃত্যুর সাথে একটা ক্ষুদ্র সাক্ষাৎকার ছিলো। একটা কষ্টকর সাক্ষাৎকার মাত্র। আমাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে এসেছিল জীবন কত অসহায়।

কি অসম্ভব ক্ষমতা মৃত্যুর! মানুষ নতুনভাবে বাঁচতে শেখায় মাত্র এক আঘাতে। সাভারে বেঁচে যাওয়ার মাননিয়ন্ত্রকের কথা শুনছিলাম বেঁচে যাওয়ার পরে। বলেছিলেন, তার মনে হয়েছিল সে নতুনভাবে জন্ম নিলো। কি অসম্ভব শক্তিশালী এই মৃত্যু!

কিন্তু আমার কোনো পরিবর্তন হয়নি। হ্যা, হয়ত ভালোবাসার মানুষগুলোকে আরও আকুল হয়ে ভালোবাসছি, কিন্তু আর সবকিছু আগের মতই রয়ে গেছে। এখনও প্রতিদিন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভাঙে, কিছুক্ষণ স্থির হয়ে বসে থাকি, ধীরে ধীরে উপলব্ধি করি অস্থির একটা অনুভূতি মস্তিষ্ককে গ্রাস করছে। আচ্ছন্ন হয়ে থাকি সারাদিন। প্রতিদিন ঘুমোতে যাই একগাদা অনুভূতি নিয়ে- রাগ, ক্রোধ, ঘৃণা, দুশ্চিন্তা, ভালোবাসা, মায়া , জেদ সবকিছু মিলেমিশে মাথায় এ কোণ থেকে ও কোণে ঘুরতে থাকে অনবরত।

আসলে আমরা কতটা অসহায়! সাভারের প্রচুর ছবি দেখছি অনলাইনে। বুক কাঁপিয়ে দেওয়া সব ছবি, তবুও কিসের খোঁজে যেন দেখে যেতে থাকি। সবশেষ যে ছবিটা দেখলাম বাংলানিউজে, অনেকগুলো লাশ ঝুলে আছে দুটো ছাদের মাঝখানে চাপা পড়ে। এক নারীর লম্বাচুলের মাথা উলটো হয়ে ঝুলছে, দুপাশে দুটো হাত, আধপচা। অনেকগুলো হাতের কঙ্কাল, ঐ দুই ছাদের মাঝে চাপা পড়ে বের হয়ে আছে, একজনের সম্পূর্ণ দুই পা…একজনের আধেক খুলি…

যখন বুঝতে পারলো তারা মৃত্যু হবেই, কী অনুভূতি হয়েছিল তাদের? আমরা জানি না, জানতে পারি না, পারবো না। কি চরম অসহায়ত্ব! এই অসহায় জীবনের কোনো মানে আছে?

হয়ত আছে। যারা এখন আর আমাদের মাঝে নেই, তাদের কাছে এই জীবনের মানে নিঃসীম। শৈশব থেকেই আমি ভীষণ জেদী, একটা সময় ভাবতাম, এমন যদি সম্ভব হত, আমার জীবনটা কাউকে দিয়ে দিতে পারতাম, বেশ হত! সবচে অদ্ভুত ব্যাপার হলে এত ভালোবাসার বন্ধনে জড়িয়ে থেকেও আমার ধারণার বিশেষ কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনও একইরকমভাবে ভাবি, আমার জীবনটা যদি আর কাউকে…।

কেন ভাবি? সাক্ষাৎকারের পরে তো আমার আরও বেশি জীবনকে ভালোবাসার কথা। হ্যা, বাসি। কিন্তু জীবনটাকে ঠিক নয়, মানুষগুলোকে ভালোবাসি, অসম্ভবরকম ভালোবাসি। জীবন সম্পর্কে, আমার জীবনটা পুরোপুরি অর্থহীন। কাউকে কখনও কিছু দিয়েছি বলে মনে পড়ে না, নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসেছি বলেও মনে পড়ে না, নিয়েছি বেশি, দেবার খাতায় শূন্য। এই জীবনের কোনো মানে আছে?

আমি ভয়াবহভাবে অন্তর্মুখী মানুষ। সবচে কাছের মানুষের কাছেও বিষাদগুলোকে চেপে যেতে ভালোবাসি। সেজন্যে হয়ত কাউকে কিছু দিতেও ইচ্ছে করে না, নিতেও ইচ্ছে করে না, তবুও মানুষগুলো জোর করে নিতে বাধ্য করে। সবচে বেশি বাধ্য করে ভালোবাসা নিতে। অথচ এ জিনিসটাই আমি দিতে জানি সবচে কম। ভালোবাসা প্রকাশের ক্ষমতাটা বিধাতা আমাকে দেননি। তাদের খাতায় তাই আমি দিয়েছি, এমন কোনো রেকর্ড নেই। বরঞ্চ অগ্রহণযোগ্য জিনিসগুলোই আমি দিয়েছি সবচে বেশি। অকৃতজ্ঞের মতো।

এতসব স্বীকারোক্তি আজ কেন দিচ্ছি জানি না। পেছন ফিরে তাকিয়ে এমন কিছু পাই না, যাতে জীবনটাকে ‘আমি সার্থক করেছি’ বলা চলে। অন্যেরা নিঃসীম মায়া দিয়ে হয়ত জীবনটা সার্থক করার চেষ্টা চালিয়েছে, কিন্তু আমার কাছে পুরোপুরি অর্থহীন। সম্ভবত শত আঘাতেও এ ধারণার পরিবর্তন হবে না।  একবার যখন হয়নি…

“আমার জীবন আমি ছড়াতে ছড়াতে
এসেছি এখানে,
আমি কিছুই রাখিনি-
কুড়াইনি তার একটিও ছেঁড়া পাতা,
হাওয়ায় হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়েছি শিমুল তুলোর মতো
সব সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা, স্মৃতি,
আমি এই হারানো জীবন আর খুজি নাই
সেই ফেলে আসা পথে;
ছেঁড়া কাগজের মতো ছড়াতে ছড়াতে এসেছি আমাকে।“

-মহাদেব সাহা/ আমার জীবন

অনন্তদিনের গল্প হল? নাহ, হয়ে গেল স্বীকারোক্তি। হোক, তবে শিরোনাম হোক ‘স্বীকারোক্তি’…

বেঁচে থাকুক স্বপ্নগুলো, বেঁচে থাকুক জীবন।

খামবন্দি অনুভূতি : মায়া ও স্বার্থপরতার কথা


প্রিয় রোদ্দুর,

কখনও এমন হয় আশেপাশের কাউকে আমরা এত বেশি আপন ভেবে ফেলি, তাদেরকে খাঁচাবন্দি করে ফেলি। আটকে ফেলি। কোত্থাও যেতে দিতে চাই না। কেমন যেন মায়ামাখানো স্বার্থপরতা! দেখো, স্বার্থপরতা কত বাজে জিনিস, তবুও তার সাথে মায়া মিশে গেলে, হয়ত সেটাও আমাদের আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। আমরা কেউ কেউ সেই মায়ামাখানো স্বার্থপরতা দেখিয়ে যাই, আর অপর পাশের মানুষটাও সেই স্বার্থপরতাটাকে উপভোগ করে, খুব বেশিদিনের পরিচয়, কিংবা পারস্পরিক মায়াটা খুব বেশি হয়ে গেলে হয়ত খানিকটা অসহায়ভাবে খাঁচার দরোজা খুলে পালিয়ে যেতে চায়। পালাতে গিয়ে আটকে পড়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জালে। “যাবো? এত মায়া ছেড়ে কোথায় যাবো?” কিংবা “ওর মন ভেঙে যাবে! ওতে কি আমার সুখ হবে?” সবশেষে, “নাহ, আমি যাবোই। কারও মায়ার বাঁধনে আমি বাধা পড়তে রাজি নই। তাও এমন স্বার্থমাখানো মায়া!” কিংবা, “থাক, অতটুকু মায়াও একসময় হয়ত আর আমার জন্যে জমা থাকবে না। যদ্দিন আছে, ততদিন না হয় থাকি…”

কি জানি! আমি অমন মায়ার বাঁধনে আটকা পড়েছি বহুবার। তবে প্রতিবারই মায়াময় মানুষগুলো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই আমাকে মুক্ত করে দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা সেইসব মানুষদের প্রতি…

তারপর আমি ছন্নছাড়া পাখির মত উড়ে বেড়াই। অন্যের ঘরে খানিক সময়ের জন্যে আশ্রয় নিই। আবার পালাই, কিছু না জানিয়ে। কিন্তু শেষবার আবার ধরা পড়লাম। খুব ভালোভাবেই ধরা পড়লাম। এখন পর্যন্ত ছেড়ে দেবার নাম করছে না।  সম্ভবত করবেও না। কে জানে! মানুষের মন…। হয়ত দেখা যাবে কোনো এক বিষাদী রাতে খাঁচা খুলে বলবে, “যাও! মুক্ত করে দিলাম তোমায়!” কী করব আমি তখন? উড়ে যাবো খুশিমনে? নাকি তখন নিজেই নিজেকে জোর করে খাঁচার ভেতর আটকে রাখবো। তার খাঁচা থেকে মুক্ত হতে চাইবো না? হতেও পারে!

ভাবছো, আমি, যে কি না, বারবার মুক্ত হয়ে উড়ে যেতে চেয়েছি, সে কেন নিজেকে মুক্তজীবন থেকে মুক্তি দিয়ে আটকে রাখতে চাইবো? ওই যে, স্বার্থমাখা মায়া! আমার স্বার্থমিশ্রিত মায়ার টানেই আমি যেতে চাইবো না। শেকলবন্দি হয়ে থাকবো আজীবন। কি বিচিত্র মানুষের মন!

আজ সকালে আমার এই খাঁচাবন্দি পাখিটির দুশ্চিন্তায় অসময়ে উঠে গেলাম। হুম, সকালটা আমার ঘুম ভাঙার পক্ষে অসময়ই বটে। রাতেও ঘুম হয়নি। অস্থিরতায় ছটফট করেছি সারারাত। কারণটা স্রেফ মায়ামাখানো স্বার্থপরতা। তাকে আজ দিনকয়েকের জন্যে মুক্ত করে দিচ্ছি। কিন্তু চাইছি না। আমি হয়ত আজীবন খাঁচাবন্দি থাকতে রাজি আছি, পাখিটি তা নয়। তার মুক্তজীবনে সে কারও বাধা মানবে না। আমিও দ্বিধান্বিত হয়ে যাই, স্বাধীনতার মাঝে আমি পরাধীনতার ছায়া ফেলবার এমন কে? তবুও অযাচিত অধিকার খাটাই। ভাবি, যেতে দেবো না। কোনোভাবেই না। অমন খুঁজে খুঁজে হঠাৎ পাওয়া পাখিটিকে এত সহজে যেতে দেবো? যদি সে হারিয়ে যায়? পথ ভুলে আর ফিরে না আসে? শঙ্কায় আকুল হয়ে থাকি।

তবুও, শেষমেষ কিছু করার থাকে না। কিছু পাখিকে সাময়িকভাবে পাওয়া যায়, খাঁচাবন্দি করে, মায়ার শেকলে বেঁধে খানিক আনন্দ পাওয়া যায়; তবু তাদের মন পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমরা কারও কারও জন্য কখনও সব সুখ উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত থাকি, তারা থাকে না, তারা চায় না, ভাবে, “একসময় সব বাঁধা ছেড়ে পালাবো, ওকে আমার ভালো লাগে না। যাকে ভালো লাগে না, তার জন্যে কেন সব সুখ উৎসর্গ করে দেবো? ও আমি পারবো না’।

একটা কবিতা থাকলো শেষে। হয়ত বুঝবে। তুমি কবিতা আমার থেকে অনেক ভালো বোঝো।

“হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷

তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে৷

নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়ে তো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷

তুই কেমন করে যাবি?

–   যাত্রা-ভঙ্গ/নির্মলেন্দু গুণ

প্রশ্ন রইলো শেষে।

শুভ হোক যাত্রা।

ইতি,

কাঠপুতুল

খামবন্দি অনুভূতি : প্রিয় কথা ও অন্যান্য


প্রিয় রোদ্দুর,

আজ মনে হচ্ছে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি হলে বেশ হতো। ভাবছো, “ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি”টা কেমন? সেটাকে তুমি আরও কিছু শব্দ দিয়ে বিশেষিত করতে পারো। ঝুম বৃষ্টি, অঝোর বৃষ্টি; এরচে ভালো কোনো বিশেষণ কি তুমি খুঁজে বের করতে পারবে? অভিধান ঘাঁটতে যেও না। বরং ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াও। হাতদুটোকে আড়াআড়ি ভাঁজ করে রাখতে পারো। চোখ বন্ধ করো। তারপর ভাবো, একটু একটু করে মৃদুলয়ে নুপূরের শব্দ শুনতে পাচ্ছো। ঝুম ঝুম ঝুম…ধীরে ধীরে শব্দটা বাড়ছে দেখো। প্রথমে থেমে থেমে, তারপর একটানা বেজেই চলেছে। মেঘকন্যা তার বন্দিজীবনের মুক্তির আনন্দে অবিরাম নেচে চলেছে। ধূসর-নীলচে আঁচল লুটোচ্ছে নরম তুলোর মত মেঘের গায়ে। আর তার পায়ের নুপূর একটু করে সিক্ত হচ্ছে। নুপূরের শব্দটা কি বেড়েছে অনেক? এবার তবে সে থামবে। তার পায়ের নুপূর চুইয়ে জল পড়ছে টুপটুপ। এবার চোখ খোলো।

আমি খুব ভালো বিবরণ দিতে পারিনি জানি। আমি আসলে কিছুই পারি না, কিছুই বুঝি না। আমি শুধু অনুভব করতে পারি। তাও বোধহয় তোমার মতো করে নয়। আমার দুর্বল বাক্যবিন্যাসে হয়ত তুমি শুধু অঝোরধারার বৃষ্টিই নয়, মেঘকন্যার নাচের সাথে খানিকটা ক্রোধের মিশ্রণ ঘটিয়ে কালবৈশাখী ঘটিয়ে ফেলেছো!

আমরা হয়ত জানতে উৎসুক থাকি, আমাদের প্রিয় মানুষগুলো আমাদের কাছে কতটুকু প্রিয়। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনো উত্তর নেই। আমার এক সহপাঠিনীর কথা মনে পড়লো। সে হয়ত খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু বোধহয় আমিই তাকে সুযোগটা দিইনি। কেন দিইনি জানি না। আমার খুব কাছের একটামাত্র বন্ধু আছে, আর আমিও কেমন উন্মাদ, আমি তার সময়টুকু কারও সাথে ভাগ করে নিতে চাইনি। চেয়েছিলাম, তার জন্যে জমা রাখা সময়টুকু শুধু তার হাতেই দেবো। সেই জের ধরে সরানো মানুষগুলোর মধ্যে তাকেও ফেলে দিলাম। একদিন কথাপ্রসঙ্গে সেই সহপাঠিনীটি বলল, “তোমার সাথে আমার যতটুকু বন্ধুতা হয়েছে, তাতে তোমার কোনো অবদান নেই। সবটা আমার করা। এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। তুমি কেমন যেন মাঝে একটা দেয়াল তুলে রাখো সবসময়”।

প্রথমবার কেউ আমার একটা প্রকৃতি বুঝতে পারলো। আমি নিজেও জানতাম না। বুঝতাম না, কেন আমার খুব ভালো কোনো বন্ধু হয় না, কিংবা আমি কেন প্রাণখুলে কারও সাথে কথা বলতে পারি না, আর দশজনের মাঝে প্রাণখুলে হাসতে পারি না। এখন বুঝি। অদৃশ্য দেয়ালটাই কারণ। তবুও আমি চাই না, দেয়ালটা ভেঙে যাক। অন্তত একটা বন্ধু আছে, যে এই দেয়ালটাকে পেরিয়ে চলে এসেছিলো। যদি সত্যিকার অর্থেই সে পারে, তবে হয়ত আরও কেউ পারবে। বেশ ভালোভাবেই পারবে। আমার বন্ধুটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে, হয়ত এই দেয়াল পেরিয়ে আসার জোরেই।

কি যেন বলতে বসেছিলাম। নানা কথার ফাঁদে হারিয়ে যাচ্ছি। আজকাল কেমন আনমনা হয়েছি দেখেছো? অন্যের কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগে না জানি, কিন্তু চিঠি পড়তে হয়ত তোমার বেশ লাগে। তোমাদের ছাদে জবা ফুল আছে? আমার খুব দরকার। বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালে কাটতে হবে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। ভেবে দেখো তো, এইচএসসি পরীক্ষার সময় শত শত গাছ থেকে টুপটুপ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রক্তলাল জবা? আজকাল জবাফুলের নানা জাত দেখি। সেদিন দেখলাম কমলা রঙের জবা। আরেকজনের হাতে গোলাপি জবা। তবে রক্তলাল জবাই সম্ভবত সবচে সুন্দর, অতুলনীয়। ‘সম্ভবত’ শব্দটা ব্যবহার করলাম কেন ভাবছো? জবা আমার কখনই ভালো লাগেনি। জবা নামটাও ভালো লাগেনি। জবার পরিবর্তে তার যদি নাম রঙ্গন কিংবা কাঞ্চন কিংবা মল্লিকা কিংবা নিদেনপক্ষে শিউলি বা বকুল হত, তবে হয়ত জবাকে আমি একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। নামে কি এসে যায়, তাই কি বললে আপনমনে? বেশ, রহিমা কিংবা করিমা কারও নাম শুনলে যতটুকু ভালো বোধ হয়, তারচে বেশি কি অনিন্দিতা কিংবা সুপ্রভা নামটা শুনতে বেশি শ্রুতিমধুর লাগে না? হরিশঙ্কর জলদাসের রামগোলাম পড়ছিলাম, সেখানে মেথরসর্দার গুরুচরণের পৌত্রের নাম তিনি রামগোলাম রেখেছিলেন যাতে করে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের কাছে সে সম্মান পায়। রামায়ণের রাম থেকে রাম, আর গোলাম হচ্ছে ইসলাম ধর্ম থেকে। লাভ হয়নি। রামগোলাম ছন্নছাড়া হয়েই শেষমেষ ঘুরে বেরিয়েছিলো। মানুষের অদৃষ্ট কি অদ্ভুত, না? যতই আমরা বলি, ভাগ্য বলে কিছু নেই, কিন্তু সেই ভাগ্যের ফেরেই আমরা নিতান্ত অসহায় হয়ে পড়ি। হয়ত কর্মফল।

কর্মফল নিয়ে প্রথম আমাকে একটা ছবি দিয়েছিলো ফেসবুকের এক বন্ধু। কূপজলের অনুভূতিহীন মানুষ। আমাকে বলেছিলেন, “কর্মফলে বিশ্বাস করো?” আমি বোধহয় বলেছিলাম, “জিনিসটা ঠিক বুঝি না’। ছবিটার মর্মার্থ ছিল, মানুষ যা করে, তার দশগুণ (নাকি দ্বিগুণ?) ফিরে পায়। খানিকটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি জিনিসটা। পৃথিবী কত বিচিত্র, না? কত রকম বিশ্বাস মানুষের…

কি যেন লিখতে বসেছিলাম তাই ভুলে গেছি। বড় অন্যমনস্ক থাকি। এখন হয়ত প্রায়শই চিঠি পাঠানো হবে তোমাকে। আকাশের ঠিকানায় পাঠাবো না। আমি তো যক্ষের প্রেমিকা নই, যে, দূরদেশে যক্ষের কাছে চিঠি পাঠাতে মেঘকে বর্ণনা দেবো সেই দেশের! তোমার ঠিকানা জানা আছে, সোজাসুজি সেখানেই পাঠাবো। শুধু শুধু লিখবার জন্যে তো লেখা নয়, তোমাকে জোর করে পড়ানোর জন্যে লেখা। অবশ্য তোমার উত্তর আসেনা কখনই। আসবার কথাও নয়। তুমি চিঠি লিখতে জানো না।

আপাতত আর পারছি না। তীব্র মাথাব্যথায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তবুও থামা যাচ্ছে না। জীবন প্রবহমান। জীবনটা এত বেশি গতিশীল আজকাল, একটু থেমে গেলেই বন্ধ ঘড়ির মত অচল হয়ে যাবার শঙ্কা পেয়ে বসে। আমার আশেপাশে আর কেউ নেই যে আমাকে আবার ঠেলে সচল করে দেবে। এমন জীবনের কী মানে?

“আচমকা স্রোতের পাশে হেলে পড়া কম বৃক্ষটি
এরও কোনো মানে আছে।

নির্জন মাঠের পোড়োবাড়ি- হা হা করে ভাঙা পাল্লা
এরও কোনো মানে আছে?

চেনা বানানের ভূল বারবার। অকস্মাৎ স্মৃতির অতল
থেকে উঠে আসে গানের দু’একটা লাইন
বারান্দায় পাখিটি বসেই উড়ে যায়
হেমকান্তি সন্ধ্যার আড়ালে
এর কোনো মানে নেই?”

–   মানে আছে/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

আজকাল কবিতা পড়ি, সময় পেলে। হয়ত সবটা বুঝি না, কিন্তু বুঝতে চাই, ব্যাকুলভাবে বুঝতে চাই!

ভালো থেকো।

ইতি,

কাঠপুতুল

খামবন্দি অনুভূতি : হাসিকান্নার গল্প


প্রিয় রোদ্দুর,

মাঝেমধ্যে কী এমন হয় না, ভীষণ বিষাদে হৃদয় কেমন যেন নুইয়ে পড়ে? অদ্ভুত একটা কথা, বুঝতে পারছি, এর মাঝেই নাকমুখ বিকৃত করে উৎকট একটা মুখ করে ফেলেছো। পেছন ফিরে লাইনটা পড়ে নিজেই হেসে ফেললাম। আজকাল অকারণে হাসি। হাসি নিয়ে সবচে মজার ঘটনাটা হয়েছে দিনদুয়েক আগে। কি কারণে এক বন্ধুকে ফোন করে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে কেঁদে ফেললাম। এই আর এক জ্বালা! কান্না শুরু করলে থামানোটা মুশকিল হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুটি বলল, “কাঁদতে কাঁদতে বন্যা ভাসায় দেবে নাকি?” একটু থেমে চোখ মুছে বললাম, “বন্যা হয় নাকি কাঁদতে কাঁদতে?” বলল, “এই যে, ফোনের এই পাশে পানি চলে এলো যে! ফোঁটা ফোঁটা…” শুনেই হাসিতে ফেটে পড়লাম। বললাম, “এই ব্যবস্থা থাকলে তো বেশ হতো। ধরো, কারও উপর খুব রাগ। ফোন দিয়ে এপাশ থেকে পানি ঢালা শুরু করবো, সব পানি কানের এ পাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে যাবে!” হাসি থামানোটা কষ্টকর হয়ে গেছিল সেদিন।

আপাতত তেমন কোনো হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে জানো বোধহয় হাসির জন্যে আমার তেমন কোনো কারণ লাগে না। এ মুহূর্তে সেরকম কারণও খুঁজে পাচ্ছি না, যাতে প্রাণখুলে হাসা যাবে। হুমম, ফেসবুক খোলা আছে। বিভিন্ন মজার পেজের ছবিগুলো দেখে সাময়িক একটা হাসি খেলে যায়, তবে সেটা স্থায়ী নয়। নিজের মাথায় কোনো উদ্ভট জিনিস কল্পনা করে হাসতে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। যেমন ধরো, আম্মুর সামিলকে ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করানো কিংবা রাস্তার ধারে গাছের নিচে চায়ের কাপ হাতে বসা কারো চায়ে উপর থেকে টুপ করে কিছু একটা এসে পড়া…; থাক, রাত দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি, এখন একা একা হাসলে স্থায়ীভাবে মানসিক হাসপাতালে ব্যাগ গুছিয়ে থিতু হতে হবে হয়ত!

সেটা হয়ত খারাপ হত না। বাসায় থাকতে থাকতে আমার অবস্থা হয়েছে ছোটবেলার সেই কলমের ম্যাজিকটার মত। দুটো কলমকে আড়াআড়ি কিছুক্ষণ একেবারে স্থির করে ধরে রাখলে তারপরে সেটাকে ওঠাতে গেলে একটু বাধা পেতে হয়। কেমন যেন চুম্বকের মতো টেনে রাখে কলমদুটো। আমার অবস্থা হয়েছে কলমদুটোর মতো। এখন আর একদমই বেরোতে ইচ্ছে করে না। স্বেচ্ছানির্বাসনে আছি। নিজেকে নিজের জগতেই নির্বাসন দিয়েছি। ভালোই লাগে। ভালো লাগতোও একসময়। তবে মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। পালাতে ইচ্ছে করে। একা একা পালাবোও বা কোথায়? বড়জোর এই শহরের অলিগলি পর্যন্তই হারাতে পারবো। আমার সাদা-নীলাভ আকাশ কিংবা সবুজ সিক্ত শিশিরের স্পর্শ এই ইট-কাঠের শহরে আমি কোথায় পাবো? পালিয়ে তো উদ্দেশ্য সাধন হবে না। লাভ কী?

তাই ইচ্ছেটাকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ঘুমাক, যখন আমার অঢেল সময় হবে, যখন আমার কাছে কারও কিছু চাইবার থাকবে না কিংবা যখন নিজের কাছে নিজেরই কিছু চাইবার থাকবে না, তখন ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে দেবো। সাবধানে তার গায়ে সূর্যরশ্মি ছুইঁয়ে বলবো, “রাজকন্যা, তোমার ঘুম ভাঙবার সময় হলো”। তারপর…

তারপর নিঃসীমভাবে ছুটে বেড়ানো। ভাবছো, ছুটতে কেন হবে? কিংবা কেন ধীর পায়ে হাঁটবো না? আহ, এত খুঁটিয়ে প্রশ্ন কোরো না। সবুজ ঘাস কিংবা নরম মাটির দেখা পেলে তাতে ধীর পায়েই হাঁটবো। ঘাসফুলগুলোকে এড়িয়ে, তাদের বড় কষ্ট হয় জানো? হুমম, তোমার জানার কথা নয়। কেমন করেই বা জানবে? কখনও কি দেখেছো, তোমার পাশে, তোমারই মতো একজন মৃতবৎ নুইয়ে পড়ে আছে? আমি দেখেছিলাম। সে কথা আরেকদিন হবে। আপাতত একটু স্বার্থপর হই।

বোধহয় খানিকটা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছো। বিষাদে কিভাবে হৃদয় নুইয়ে পড়ে, তা জানতে। একেকজনের কাছে হয়ত এর ব্যাখ্যাটা একেকরকম হবে। আমার কাছে বিষাদে নুইয়ে পড়া মানে প্রবল বিষাদে অসীম নৈঃশব্দ্যের মাঝে ডুবে যাওয়া। সামনের ফেব্রুয়ারিতে আঠারোয় পা দিচ্ছি, তবে সেটা পৃথিবীতে আমার বিচরণকাল মাত্র। মনের দিক থেকে আমি আঠারোর ধারে কাছেও বোধহয় পৌঁছোইনি। এখনও অনেক কিছু বুঝি না, জানি না, চিনি না। তবে পার্থিবভাবেই টিনেজটাইমটা পেরিয়ে যাচ্ছি। টিনেজটাইমের কোনো শ্রুতিমধুর বাংলা জানলে জানিও। এটার আভিধানিক বাংলাটা আমার ভালো লাগে না। যা বলছিলাম, আগে বোধহয় দেখেছো, রেগে গেলে কিংবা বিষণ্ণ হলে কোনো না কোনোভাবে সেটাকে বের করে দিতাম। কে যেন বলেছিল, রাগী মানুষদের হৃদয় পরিচ্ছন্ন থাকে। হয়ত নিজের হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন রাখতে চাইতাম বলেই সেই ক্রোধটাকে বের করে দিতাম। এখন আর দিই না। এখন নীলাকাশে ভাসিয়ে দিই। আকাশের হৃদয়টা কত বড় দেখেছো? কতকিছু সে দেখে, কতকিছুকে সে টেনে নেয়, কতকিছুকে সে সহ্য করে নেয়। আমাদের হৃদয় আকাশের মত এমন বড় হয় না কেন? মাটির পৃথিবীতে থেকে আমাদের হৃদয়টা এমন কর্দমাক্ত, ধুলোমাখা হয়ে যায় কেন?

বারবার এ কথা থেকে সে কথায় চলে যাচ্ছি। আজ বড় বিক্ষিপ্ত লাগছে। অথচ এখন আমার থাকা দরকার শীতের সমুদ্রের মত শান্ত, ঢেউহীন। অথচ আজই যেন ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রচণ্ডবেগে সবকিছুকে ধ্বংস করে দিতে চাইছি। এটা বোধহয় ঠিক ধ্বংস করবার ইচ্ছেও নয়। কী হতে পারে? আগ্নেয়গিরি? উপমাটা খানিকটা হাস্যকর। তবে বোধহয় এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত উপমা। জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ সিনেমাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। শেষদিকে এরকম একটা দৃশ্য ছিল। একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির আশেপাশে সবুজের সমারোহ, হঠাৎ করে ভেতর থেকে পাথর বেরিয়ে আসতে শুরু করলো প্রবল বেগে। এরকম কিছু একটা। মনে পড়ছে না।

যা বলছিলাম, আঠারো। এখন কেন যেন আর সেভাবে রাগটাকে প্রকাশ করি না। রাগ হলেও নিজেই নিজেকে শান্ত করি। কেন যেন সর্বক্ষণ একটা অসহায় অনুভূতি হতে থাকে। মনে হয়, খুব অল্প সময় হাতে আছে, সেটুকু যদি রাগের মত অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ব্যয় করি, তাতে কোনো সুখ নেই। আজকাল আর আগের মত মন খারাপও করি না। তার অবশ্য কারণ আছে। সময় কোথায়? প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি আজকাল। মনখারাপের ক্ষেত্রেও হয়ত সেই অল্প সময়ের তাড়নাটা কাজ করে। হেসে ফেলি, শান্ত থাকি, স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করি।

আজ আর লিখছি না। বিশাল লম্বা চিঠি হয়ে গেলো। একটা বাক্য দিয়ে কতকিছু লিখে ফেললাম দেখেছো? তবুও যেন অনেক কিছু বলা হলো না। ঠিক যেমন সুনীলের মত। কত কাজ বাকি রেখে চলে গেলেন। তার প্রথম আলো বইটা পড়া শেষ করিনি এখনও। তবে ভীষণ ভালো লাগছে পড়তে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ভূমিসূতাকে কেন্দ্র করে চরিত্রগুলোর আবর্তন, আর হ্যা, কাদম্বরীর চরিত্রাঙ্কন। পড়াশোনা সামলে নিয়ে আশা করি বাকি লেখাগুলোও পড়ে নিতে পারবো। এর মাঝে সত্যজিতের ছোটগল্পগুলো পড়া হয়েছে। ।“বর্ণান্ধ” গল্পটার কথা প্রায়শ মনে পড়ে।

“কী ভাবছো তুমি? ভাবছ আমি দুর্বল! ভাবছ যে, ভাগ্যের চাকার তলায় সেইজন্যেই আমি গুঁড়িয়ে গেছি! নিজের কথা বলতে পারি, আমি যে আত্মহত্যা করিনি কেন, এই কথা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাই। কারণটা হয়ত এই যে, বাঁচতে আমার ভারী ভালো লাগে, আর নয়ত আমি ভীতু, কাপুরুষ। হয়তো সেটাই সত্যি কথা। নইলে দ্যাখো আজ আমার কাছে জীবনের কী অর্থ? শিল্পের কী অর্থ? যে লোক ধূসর ছাড়া…হরেক রকমের একঘেয়ে ধূসর ছাড়া কোনও রঙই দেখতে পায় না, সেজন্যে মাতিস আর রেনোয়ার ছবিরই বা তার কাছে কী অর্থ?”

ভালো থেকো।

-কাঠপুতুল

কনফেশান-১


ভাবছি লেখাটার নাম দেবো কনফেশান। এটার বাংলা কোনো প্রতিশব্দ জানা আছে? হুম, স্বীকারোক্তি। তবে এরচে যেন কনফেশান শব্দটাই বেশি ভালো লাগছে। না?

লেখাটার আসলে কোনো অর্থ নেই। আমার কোনো লেখারই অর্থ থাকে না। আমার কোনো কাজেরও ইদানিং কোনো অর্থ নেই। উন্মাদ হয়ে গেছি আজকাল। এলোমেলো, অগোছালো, একটু কঠিন শব্দ ব্যবহার করলে ছন্নছাড়া বলা যেতে পারে। চরিত্রের সব কঠিন দিকগুলো একেবারে তুঙ্গে উঠে বসে আছে। প্রচণ্ড রকম স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছি। প্রচণ্ড জেদী ছিলাম আগে থেকেই, মাঝে কিছু কমিয়ে এনেছিলাম। তবে তার জায়গায় এসে গুছিয়ে বসেছিলো অভিমান। এখন একসাথে জেদ-অভিমান সব দৌড়োতে শুরু করেছে। দু’শ মিটার রেস যেন, স্বর্ণপদকটা পেতেই হবে…

ইদানিং খুব হিসেব করে চলি। সময়কে অসংখ্যবার হিসেবের খাতা-কলমে বাঁধা ফেলতে চেয়েছি। পারিনি। সবশেষে বুঝেছি, আমার সময় চলে আমার প্রতিমুহূর্তের মানুষগুলোকে  কেন্দ্র করে। আমার উন্মাদভাব (উন্মাদ’র বিশেষ্য কী? উন্মাদনা?) ইদানিং বেড়েছে প্রচণ্ড মাত্রায়। যখন তখন সব ছুঁড়ে ফেলে ঘুমিয়ে পড়ি, যখন তখন সব ছুঁড়ে ফেলে Poets of the fall এর কাছে আশ্রয় নিই, ঘর আঁধার করে তাদের সুরে হারিয়ে যেতে যেতে টুপ করে ঘুম…তারপরে স্বপ্নে বিচরণ।

কাল রাতে হঠাৎ দাদুমণিকে স্বপ্নে দেখলাম। তার সাথে আমার অভিজ্ঞতা বরাবরই খুব তিক্ত। যা হোক, স্বপ্নে দেখলাম, উনি (দ্বিতীয়বার?) মৃত্যুশয্যায়। আমরা সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে। আমি কিছুটা বেশি দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে। উনি হাত নেড়ে ডাকলেন। ভীত পায়ে এগিয়ে গেলাম ছোট্ট আমি। উনি দুহাতে আমার মুখ আঁকড়ে ধরে স্মিত হেসে আশীর্বাদসূচক কিছু বললেন। এরপরেই আচমকা ঘুম ভেঙে গেল।

তাকে দেখার দিন আমি আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যাই। প্রচণ্ড অস্থিরতায় সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। একরকম বিষাদ, একরকম অযৌক্তিক ঘৃণাবোধে আমি ক’টা দিন নুয়ে থাকি।

আজকাল আর প্রিয় মানুষগুলোকে স্বপ্নে দেখি না। প্রিয় শব্দটা খুব আপেক্ষিক। অন্তত আমার জন্যে। আজ যে প্রিয়, কাল হয়ত কোনো তুচ্ছ কারণে আঘাত পেয়ে, আকাশছোয়া অভিমানে তাকে ছুঁড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করব না। স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সীমা নেই আজকাল। প্রায় সব প্রিয় মানুষকে প্রচণ্ড অভিমানে সরিয়ে দিয়েছি দিন কয়েক আগে। আমি তাদের বুঝি না, তারা আমাকে বোঝে না। অবশ্য অস্থিরমতি ছটফটে আমাকে কারোরই বোঝার কথা নয়। আমার এই স্বেচ্ছাচারিতা-জেদ-অভিমানের কাঁটায় আর কাউকে বিঁধতে ইচ্ছে করে না। পুরোপুরি নিজের মত থাকতে চাই। সবশেষে আবার সেই এক কোণেতেই আমার আবাস…

আজকাল আর ঘর থেকে বেরোতেও ইচ্ছে করে না। আগে অস্থির হয়ে থাকতাম, কখন বেরোবো, কোথায় যাবো। এখন আর ইচ্ছে করে না। মাসে অন্তত তিনবার ডাক্তারের মুখদর্শন করতে হবে, সেটাও যেতে ইচ্ছে করে না। শুধু কলেজে যাই, তারপরে ঘর। শুয়ে, বসে, বুকশেলফের ডেস্কে পা ঝুলিয়ে, কিন্তু ড্রেসিং টেবিলের টেবিলটপে পা ঝুলিয়ে, পড়ার টেবিল, বইখাতায় ডুবে থাকা আমার চব্বিশ ঘণ্টায় ঘড়ির কাঁটা কতবার লাফঝাঁপ দিয়ে যায়, খেয়াল থাকে না।

থাক। আজকে আর লেখার মুড পাচ্ছি না। আসলে আমি লিখতেও জানি না। শেষে গানের দুটো লাইন দিই।

 “অজস্র দিন হেঁটে চলে যায়
জেগে থাকা রাত দুর্বিষহ
চুপ করে যাওয়া খামখেয়ালি
নিভে যায় সব তারা অহরহ…

তুই নেই তাই
তুই নেই তাই…”।

ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সব মানুষেরা ভালো থাকুক।

চোখ


খুব মনোযোগ দিয়ে গোল্ডফিশগুলোকে লক্ষ করছিলাম। অদ্ভুত একটা গোল্ডফিশ বারবার নজর কেড়ে নিচ্ছিলো। মাছটার চোখের কোটরটা শূন্য। কিন্তু বেশ চমৎকারভাবে পাখনা নেড়ে নেড়ে স্বচ্ছ জলের মাঝ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে আরও অনেকগুলো ক্ষুধার্ত গোল্ডফিশ ভাসছে। ভাসছে একজোড়া কালো শার্কার। গোল্ডফিশটা জানে না, সে কতটা আকাঙ্ক্ষিত। তার মৃত্যু কতটা আকাঙ্ক্ষিত এই রোজ একঘেয়ে ছোট লাল দানার খাবার খাওয়া পোষা মাছগুলোর কাছে। সে জানে না, তার চারপাশে স্বচ্ছ জলের মাঝে একটা নোনা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে, মৃত্যুদূত তার নোনা সুবাস ছড়িয়ে তার পিছু পিছু ঘুরছে। আচমকা হয়ত গোল্ডফিশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপরে। তার নরম সোনালি শরীর একটু একটু করে একটা ঠুকরে ঠুকরে খাবে তারই এতদিনের বন্ধুরা, তার এই বন্দিজীবনের বন্ধুরা। দিন পেরোবে, রাত পেরোবে, ঘড়ির কাঁটাগুলো একটার পর একটা সংখ্যা পেরিয়ে যাবে। আমার এই অন্ধ বন্ধুটির শরীর ততক্ষণে চাপা পড়বে সাদাকালো মার্বেল পাথরের নিচে। শেষমেশ হয়ত একটা মাঝারি আকারের কাঁটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ভাসমান অবস্থায়। নাও পাওয়া যেতে পারে।

 

বন্ধুটির জায়গায় হয়ত আর একজোড়া নতুন গোল্ডফিশ নিয়ে আসা হবে। সূর্যাস্তের আবির রঙা তার ছোট্ট শরীরের মাপের আরেকটা গোল্ডফিশ। বছর তিনেক পরে নতুন গোল্ডফিশটা আমার মতই কিশোর হয়ে উঠবে। আমার মত প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে। তাকে আমি অন্ধ হতে দেবো না। সে দেখতে পাবে তার মুখোশপরা রূপবান বন্ধুদের। দেখতে পাবে তার মৃত্যু্র আকাঙ্ক্ষারত বন্ধুদের। তাদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলবে। আবার সময় পেরোবে, দিন পেরোবে, রাত পেরোবে, দেয়ালঘড়িটার কাঁটাগুলো ৩৬০ ডিগ্রী কোণ পরিভ্রমণ করতে করতে টেবিল ক্যালেন্ডারকে জানান দেবে তার বেশ পরিবর্তন করবার কথা। ততদিনের বন্ধুটি হয়ে উঠবে হান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যাণ্ডারসনের সেই কুচ্ছিত হাঁসের গল্পের হাঁসের মত। ছোট্ট এক রত্তি গোল্ডফিশ ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠবে রূপবান ঈর্ষণীয় একটা মাছ।

 

আহ! কবে আসবে সেদিন? ততদিন পর্যন্ত কি আমার এই অন্ধ বন্ধুটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না? তাকে এই মৃত্যুকামী বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে তাকে নতুন জীবন দেওয়া যায় না? নাইবা দেখতে পেল সে আমাকে। কিন্তু তার প্রতি তো আমার ভালোবাসার অন্ত নেই। আমার ধারণা তার অন্ধ জীবনকে সে বেশ পছন্দই করবে। আমরা দু’জন একসাথে সাঁতরে বেড়াবো আলোহীন এক জগতে। কি এসে যায়? আমার মাছবন্ধুটিও জানে না তার মুখোশপরা শত্রুদের পরিচয়, আমিও জানি না। কি অসম্ভব একটা মিল আমাদের মাঝে! আমাদের জীবন এমনিভাবেই ভাসমান। এক কাঁচবাক্সে, একই জলে, একই কৃত্রিম ভাসমান গাছের মাঝে আমাদের বসবাস…

 

“আম্মু, দেখো এ্যাঞ্জেলমাছটাকে সবগুলো মাছ ঘিরে ধরেছে! ঠোকরাচ্ছে!” “ওরকম একটু হয়ই সোনা। তুমি বরং একটু বাগানের দিকে যাও। নতুন গোলাপ চারাগুলো লাগানো হচ্ছে”।

 

আমি তবুও খুশি। ক্ষুধার্ত গোল্ডফিশগুলোর সাথে আমার চুক্তি হয়েছে। আমি মারা গেলে তারা আমার চোখদুটোকে উপড়ে তুলে আমার বন্ধুটির চোখে বসিয়ে দেবে। কি চমৎকার একটা চিন্তা! সমুদ্রে থাকতে মা বলত, আমি খুব বুদ্ধিমান একটা বাচ্চা। মা থাকলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন। মা বলতেন, বন্ধুদের জন্য সব উজাড় করে দিতে হয়। আমি আমার চোখ দিয়ে দিচ্ছি আমার বন্ধুটিকে। এখন সে একটা অপূর্ব গোল্ডফিশ হয়ে উঠতে পারবে। তার চোখ থেকে আমার চোখ দিয়ে কাঁচবাক্সের গায়ে বন্ধুটির নিত্য পরিবর্তন দেখতে পাবো। দেখতে পাবো আমাদের জলজ জীবনকে।

 

-“আম্মু, এটা কিভাবে হল?”

-“জানি না সোনা।“

-“কি বীভৎস! একুরিয়ামের একটা মাছেরও চোখ নেই! চোখহীন এতগুলো মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে!”

-“এই যে এই গোল্ডফিশটার এখনও চোখ আছে! এটাকে একটা জারে দিয়ে দাও সোনা।“

-“কিন্তু আম্মু, এটার চোখটা যেন কেমন! গোল্ডফিশের চোখ কি এমন থাকে?”

-“জানিনা সোনা”।

কাঠপুতুলের গল্প-৪ : আত্মকথোপকথন


-আজকাল ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছো। আগেকার সেই জেদ অভিমান অশ্রুবর্ষণ ক্রোধ কিছুই আর তেমনভাবে তোমাকে আক্রান্ত করে না দেখছি!

– হুম, কি প্রবল ক্রোধে সব তছনছ করে দিতাম কিছু না পেলে। ভালোবাসার খানিক অভাববোধ হলে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নীরব অশ্রুবর্ষণের সেই প্রবণতাটা আজকাল হাস্যরসের যোগান দেয় আমার। কথায় ভালোবাসার অনুপস্থিতিবোধে সীমাহীন অভিমানে ধ্বংস করে দিতে চাইতাম সব…

-সেই তো ভালো। কাঠপুতুল কৈশোরের বন্ধ দরজা পেরিয়ে তারুণ্যের মুক্ত আকাশের দিকে এগোচ্ছে…বুঝতে শুরু করেছে, নিষ্প্রাণ-নিষ্ঠুর-স্বার্থপর এই পৃথিবীতে আমাদের কারোর জন্যেই কারো সময় নেই।

-একটা জিনিস এখনও বদলায়নি। বোধহয় বদলাবে না।

-জানি, সময় চেয়েও না পাওয়া।

-এই একটামাত্র অপার্থিবের কাছে নিয়তই আমি পরাজিত। কে জানে, একসময় হয়ত এমন দিন আসবে, যখন আমার কাছে কেউ সময় চেয়ে ব্যর্থ হবে।

-এতদিনকার অপ্রাপ্তির মধুর প্রতিশোধ হবে তখন, নয় কি?

-প্রতিশোধ নিয়ে লাভ? আমার ক্রোধের বিলুপ্তি ঘটছে ক্রমশ। প্রতিশোধ নিতে সীমাহীন ক্রোধের দরকার হয়। আজকাল সেই ক্রোধটা পরিমাপের আওতায় এসেছে। প্রতিশোধ বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই…
-তোমার এই কোমলতা আর করুণাকে আমি ঘৃণা করি। *
-করতেই পারো। আমাকেই ঘৃণা করতে পারো। ঘৃণা করতে পারো আমার এই অবচেতনে বদলে যাওয়াকেও। বলতে পারো, নতুন এ পৃথিবীতে ক্রোধ-অভিমান-জেদের যত বিকাশ হবে, ততই উত্তম। কিন্তু, আমি যে বদলে যাচ্ছি আপনা থেকেই…
-বিধাতা যা ভালো বোঝেন! তিনি যদি চান, তাই হবে। কাঠপুতুল চোখের নিমিষে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে অবলীলায়।-দেখা যাক, কী হয়। এখন হয়ত খানিক ভালোবাসার স্পর্শে নক্ষত্র খানিক উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছে। হয়ত শতবর্ষ পরে সেই আবেগটুকুই নক্ষত্রকে বিস্ফোরিত করে দেবে! কে বলতে পারে, সেসব অনুভূতির বিলুপ্তি ঘটেছে; হতে পারে, সেসব জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে, উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায়, সবকিছু ধ্বংস করে দেবার জন্যে…

-সেদিন কাঠপুতুল আপন রূপে আবির্ভূত হবে। এই কোমলতা তোমার শোভা পায় না কাঠপুতুল।

-অনেকটা সময় বাকি এখনও। আঁধার নামছে দেখো…

-হৃদয়ে?

-হৃদয় তো সবসময়ে সবারই আঁধার। তাতে আলো দেবার মানুষ কই? আমরা উন্মত্ত কত দ্রুত একে অপরের হৃদয়ে অমাবস্যার আঁধার নামিয়ে দিতে পারি, কত ক্ষিপ্রতায় হৃদয়ের কোমলতাকে চূর্ণ করে দিতে পারি, নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থপরতার বীজ বুনে দিতে পারি…

-কেন বুনি বলতে পারো?

-সে তো জানা নেই। সেই সর্বগ্রাসী বৃক্ষের কোনো ছায়াও নেই যে তার নিচে ক্লান্ত পথিক জিরিয়ে নিতে পারে…

-নাহ, উপড়ে যাওয়া বিশালাকার শেকড়ের গাছ দেখেছো? শুধু শেকড়টুকু উপড়ে আসে না, যে মৃত্তিকার বুকে তার এতদিনকার নির্ভার আশ্রয়, তাকেও সে উপড়ে তুলে আনে। এমনিভাবে যখন তুমি প্রবল ক্রোধে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হবে, সেই বৃক্ষগুলো তার এতদিনকার আশ্রয়টুকু, পচে যাওয়া হৃদয়টুকুকেও তুলে আনবে তার শেকড়ের সাথে। ভাবতে পারো, তার নিচে শুদ্ধতম একেকটা হৃদয় শায়িত থাকবে। ভালোবাসা-স্নেহ-আন্তরিকতায় সিক্ত একেকটা হৃদয়…

-সেই হৃদয়ে কি করুণা থাকবে? আমার জন্যে একটুখানি সময় দেবার মত করুণা?

-নিশ্চয়ই কাঠপুতুল। একদিন না একদিন অমন একটা হৃদয়ের আবির্ভাব হবে নিশ্চয়ই…।

*কথাটা ফাতেমা আবেদীন নাজলা আপুর। আমার খুব ভালো লাগে।

কাঠপুতুলের গল্প-৩ : কাল্পনিক কথোপকথন


জানলার কাঁচে অবিরাম জলস্রোত দেখতে দেখতে কাঠপুতুল চেনা সুবাসের অস্তিত্ব টের পায়। একটু হাসে হয়তো। মুহূর্তের মাঝেই পাশে অপর এক আবছায়া এসে দাঁড়ায়।

-মনে পড়ে, কতদিন পেরিয়ে গেছে, যখন বর্ষার দিন একটুকরো জলচিঠিতে লিখে পাঠাতাম, “বেরিও না আজ”?

-বেশ মনে পড়ে। তবে সত্যি কথাটা জানাইনি কখনও।

-আজ শুনবো, বলো। অতীতের যে বর্ষার দিনগুলোতে তোমার হৃদয়ের কথা হৃদয়েই সুপ্ত থাকতো, কালের পরিক্রমায় এই বর্ষায় সেসব মুক্ত হয়ে যাক। মেঘজলে ভেসে যাক চাপা আবেগ…

-আমি কখনই বর্ষার দিনে বেরোতে চাইনে। উদ্দাম বৃষ্টিতে তো নয়ই। ঘরবন্দি মানবীর তপ্ত হৃদয়ে হঠাৎ শীতল জলের স্পর্শ পড়লে তার ফুঁসে ওঠাই স্বাভাবিক। আর সেইসব আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়েছি বহু আগেই। সম্ভবত আমার নিয়তি চার-দেয়ালের মাঝেই…

-নাহ, সেটা ভুল।

-ভুল যে নয়, সে খুব ভালো করেই জানি। আশান্বিত করা ভালো। কিন্তু যে জন্মান্ধ, তাকে আকাশের নীল রঙের ক্রমপরিবর্তন দেখানোর আশা না দেওয়াই শ্রেয় নয় কি?

-হয়তো। তবে কাঠপুতুলের ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না।

-এতটা নিশ্চিত?

-এলামই তো কাঠপুতুলকে মুক্ত করে নিয়ে যে্তে। তোমার জল ছুঁইছুঁই নৌকো আর মেঘের কোলে ছোট্ট ঘরের স্বপ্ন পূরণ করতে…

-নাহ, সে চাওয়া নেই। সেই নৌকো আর মেঘের কোলে বাড়ি আর কারো জন্যে রেখে দিও। তোমার উপযুক্ত কাউকে…

-সময় আসুক, তারা নিজেরাই উপযুক্তটিকে খুঁজে নেবে।

-অন্তত সেটা আমি নই।

-সময় বলে দেবে।

-আর যদি সময় তোমার কিংবা আমার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে চলে যায়?

-নিতান্ত দুর্ভাগ্য ছাড়া কী বলব তাকে? তবে উপযুক্ততার কারণে তোমার পদচিহ্নটা সেখানে ফুটে উঠবে আপনা থেকেই।

-জানিও, ফুটে উঠেছিল কি না।

-সে তুমি নিজেই দেখতে পাবে, নিজ চোখে।

-অপেক্ষায় রইলাম। তার আগেই যেন আলো না নিভে যায়।

-সময় আসুক। এখন বর্ষণের গান শোনো। অতীতের সাথে মিল খুঁজে পাও কি না জানিও।

-ভালো থেকো। আর থেকো অপেক্ষায়।

-আমি অপেক্ষায় নেই।

-আমি একাই তবে অপেক্ষায়?

-আমি তো নিশ্চিত কাঠপুতুল, তবে কেন অপেক্ষা?

-বেশ। যাচ্ছ এখনই?

-অরণ্য ডাকছে যে আমায়। সাড়া না দিয়ে উপায় নেই যে!

-বেশ, তোমার আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হোক। তোমার ভালোলাগা সম্ভবত ওখানেই… আমি ঘরবন্দিই থাকি। মুক্ত অরণ্যে তোমার স্থান, আর আমার এই আঁধারের কোণে। বিদায়।

কাঠপুতুল পাশ ফিরে আর অস্তিত্বটাকে খুঁজে পায়না। তার আগেই সে উড়াল দিয়েছে অরণ্যে। বরাবরের মতই, আকাঙ্ক্ষার বিনাশ ঘটিয়ে।

নিশীথিনীর দিনলিপি-১৬


বহুদিন ধরে নিজের কথা কিছু লেখা হয় না। কেমন আছি, কিভাবে আছি, কাদের সাথে বসবাস- লিখিনা অনেকদিন। কাঠপুতুলের গল্প যদিও আমারই প্রতিচ্ছবি প্রায়, তবুও তার সাথে অনেকটা কল্পনার মিশ্রণ আছে। স্বচ্ছ জলে একফোঁটা জলরং এর মতো অনেকটা। ক্রমশ মিশে যেতে থাকে। যা হোক…

১৭তে পা দিলাম এবার। একরকম অনুভূতিহীন কাটলো জন্মদিনটা। বড় হয়ে যাচ্ছি, সেজন্যে? হয়তোবা না। বরং অন্যান্যবারের চেয়ে এবারের জন্মদিনটাই কেটেছে হয়ত একটু বেশি মুখরতায়, একটু বেশি ভালোবাসার স্পর্শ নিয়ে। বারোটার ঠিক পরপরই তিতু, নাজলাপা, মুন্না ভাইয়া, শিজু’পা, গেজুপা, আনুশার উইশের রিপ্লাই দিতে গিয়ে দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছিলাম কারটা আগে দেবো। টেক্সটগুলো পড়তে অতটা সমস্যা হয় না, তবে সমস্যায় পড়ে যাই কথা বলতে গিয়ে। চোখে জল টলমল করতে থাকে, এই বুঝি নামলো, কণ্ঠটা কেঁপে উঠলো- ভয়ে থাকি। তবুও উত্তর দিই হাসিমুখে। কেন চোখ সিক্ত হয়ে আসে, জানি না। জানতেও চাই না। শুধু জানি, এই মানুষগুলোর ভালোবাসার একজন অংশীদার আমি- ব্যস, আর কিছু জানতেও চাই না।

তবে একটা অংশ ফাঁকাই থেকে গেল সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটির উইশ না পেয়ে। কী প্রকট অভিমানে তাকে লিখলাম, আমি জানি, আর সর্বদ্রষ্টা বিধাতা জানেন। এই অনিচ্ছাকৃত অবহেলায় ততক্ষণে টপটপ করে বর্ষা নামতে শুরু করেছে। অথচ আগেই বলে রাখা যে বিশেষ দিনগুলো এই বন্ধুটির মনে থাকে না। তবুও, অভিমানটা সামলে রাখা গেলো না। তাহলে কিভাবে দাবি করি , বড় হয়ে গিয়েছি বলেই জন্মদিনগুলো কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করছে না আর? আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কখনই বড় হই না। ছোট্টটি থাকি, অভিমানী থাকি। অবহেলায় মুখ ফেরাই, অভিমানে ঠোঁট ফোলাই, ভীষণ ক্রোধে বকাঝকা করি উন্মত্তের মতো; দিনের শেষে অশ্রুসিক্ত মুখে তার কাছেই ফিরে যাই।

কেন ফিরি? ভালোবাসি বলে? নাহ, ভালোবাসা হয়ত খুব তুচ্ছ একটা অনুভূতি। অন্তত এই সেলফোন-ইন্টারনেটের যুগে ভালোবাসা সূর্যের মতো। উদয়ের কালে নরম আভা ছড়িয়ে যায়, ধীরে ধীরে প্রখরতা বাড়ে, তপ্ত করতে শুরু করে, আর দিনের শেষে সবকিছুকে আঁধারের দায়িত্বে ছেড়ে দিয়ে লুকিয়ে পড়ে। ফিরে আসি এই মানুষগুলোকে ছাড়া চলবে না বলে। এটাকে বোধহয় বলে মায়া। হ্যা, হয়ত এই মানুষগুলোর জন্যে প্রচ্ছন্ন একরকম মায়া আছে আমার মধ্যে। অনুভূতিহীন কাঠপুতুলের মধ্যে।
আজকাল বোধহয় দুঃখবিলাসিতায় মেতে উঠছি প্রায়শ। এক্সাম শেষে বেরিয়ে প্রথমেই জিজ্ঞেস করি নিজেকে, “তুমি সন্তুষ্ট?” উত্তর হ্যাঁ-সূচক হয় সবসময়েই। প্রথমে মুখটা সেজন্যে হাসিখুশি রাখার চেষ্টা করি, যাতে কেউ বিপরীতটা না ভাবে। বেরিয়ে দেখি কেউ নিতে আসেনি তখনও। প্রখর রোদ পড়ছে এমন একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করি। রোদ্দুরের সাথে আমার সবসময়েই ভীষণ রকম সখ্য।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মানুষগুলোকে দেখি। একেকটা মানুষের মুখে একেকরকম অনুভূতির পরিস্ফুটন দেখি। কারও হয়ত এক্সাম ভালো হয়নি। চোখেমুখে বিরক্তি। কেউ কোন প্রশ্ন নিয়ে দ্বিধান্বিত, চোখমুখে উৎকণ্ঠা। কেউ আনন্দে আত্মহারা, কারও হতাশায় চোখেমুখে আঁধার নেমে আসছে ক্রমশ, এই তপ্ত উজ্জ্বল দুপুরে। তীক্ষ্ণ চোখে তাদের লক্ষ করতে থাকি। অত:পর আমারও ফিরবার সময় হয়। ফিরতে ফিরতে কেমন যেন বিষাদ পেয়ে বসে। চুপচাপ থাকি। কিছু বলতে ইচ্ছে হয় না। কী লাভ অর্থহীন সব শব্দমালা উচ্চারণ করে? চুপচাপ মায়া আর ভালোবাসার মধ্যে পার্থক্য খুঁজি।

এই তো এভাবেই কাটছে দিন। সরল, সাধারণ, নৈঃশব্দ্যে ঘেরা। কাঠপুতুলের দিন আর কেমনই বা হতে পারে?