১
গত এক মাস ধরে আমি ভীষণভাবে বদলে যাচ্ছি। ভীষণভাবে। বদলে যাওয়ার পরিমাণটা এত বেশি যে নিজেই হঠাৎ যখন বুঝতে পারি, আমার এমনটা করার কথা নয়, চমকে উঠি। বিস্মিত হই, ভাবি, আদৌ কি আমার মাঝে আছি কি না। নাকি অন্য কারো অস্তিত্ব এসে বিলীন হয়ে গেছে আমার মাঝে?
এই পরিবর্তিত মানুষটাকে আমি ডাকি কাঠপুতুল বলে। আমি এতদিন প্রকৃত অর্থেই মায়ামমতাহীন এক কাঠপুতুল হয়ে উঠতে চেয়েছি। বেশিরভাগ সময়েই পারিনি। মায়া বারবার ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বলেছে, “ধুৎ, এত কঠিন হলে চলে? আমি ছাড়া তুমি অর্থহীন!” ব্যস, আবার মায়া নামক অর্থহীন অস্তিত্বটাকে আপন করে ঢেলে দিয়েছি…
অভিমান, রাগ, জেদ, বিষাদ- এইসব অনুভূতিকে নেহাৎই অপ্রয়োজনীয় মনে হয়। সব আবেগ চাপা দিতে শিখেছি। প্রচণ্ড অভিমান হলেও হেসে ফেলে সব উড়িয়ে দিই। আমার অভিমান যে বড় বিধ্বংসী। আমাকে ধ্বংস করে দিতে চায়।
২
আমার ইদানিং টেলিপ্যাথি জিনিসটা মারাত্মকভাবে বেড়ে গেছে। যার কথা ভাবি, সে কোনো না কোনোভাবে সামনে চলে আসে। কিংবা তার খবরটা বেশ কিছু সময় মনকে অধিকার করে থাকে। ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘ইচ্ছে’ সিনেমাটা খুব ভালো লেগেছিল। ‘তিতলী’ দেখেছিলাম অনেক ছোটবেলা, প্রায় মনেই নেই। মৃত্যুসংবাদটা তাকে জানাতে নেহাৎ অস্পষ্ট একটা শব্দ ছাড়া তার কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে হতাশই হলাম না। কিছু কিছু মানুষ নেহাৎই অনুভূতিহীন হয়ে জন্ম নেয়। শত চেষ্টাতেও তাদের মনে অনুভূতির বীজ ডালপালা মেলে ধরতে পারে না।
কিংবা আমার ছোট্টো সাদা মাছটার কথা। তাকে আনা হয়েছিল তার আরো ন’জন বন্ধুবান্ধবসহ। দিনকয়েক কাটবার পরে তার সাথে তার বন্ধুদের খুব ঝগড়া হল। তার অভিমানটাও আমার মতো, বিধ্বংসী। ক্রোধে একে একে তার বন্ধুদের কোমল সাদা দেহ খুঁটে খুঁটে খেয়ে তার ক্রোধ মেটালো। কঙ্কালটাও খুঁজে পেলাম না। এরপরে সে শান্ত হল। আমার মতো, বহুদিন পর, সব ধ্বংস করে। আজ দুপুরে ভাবছিলাম, একা একা মাছটার বেঁচে থাকতে কষ্ট হয় না? সন্ধ্যেয় আমাকে উত্তর না দিয়েই সে নিজেকে ধ্বংস করে ফেললো তার অন্য সঙ্গীদের হাতে। মাছটার কি তখন আফসোস হচ্ছিল তার বন্ধুদের জন্যে? তীব্র অনুতাপে কি সে এতটাই দগ্ধ হচ্ছিল যে নিজেকে বাঁচাতে চেষ্টাই করেনি একটুও? আমি যেমনটা অনুতাপে দগ্ধ হই, কেন কিছু মানুষকে এত আপন করেছিলাম? কিন্তু নিজেকে ধ্বংস করে ফেলতে পারি না?
৩
সব মানুষের জীবনেই বোধহয় কিছু স্মৃতি থাকে, যার আতঙ্কে তারা উন্মাদের মত সর্বস্ব পেছনে ফেলে কেবলই সামনে এগিয়ে যেতে চায়। একদিক থেকে বোধহয় ভালোই। নেতিবাচক অনুভূতি যদি মানুষকে ক্রমশই ধ্বংস না করে সামনের দিকে ঠেলে দিতে থাকে, তাকে নিশ্চয়ই মন্দ বলা যায় না? মনে পড়ে, এসএসসি পরীক্ষার ঠিক আগের দিন এক আত্মীয়ার সাথে কথা বলার সেই অসহ্য স্মৃতিটা। আমি নিজেও জানি না, কেন এতটা ভেঙে পড়েছিলাম। তার প্রায় এক বছর পর ভাবতে ভাবতে হঠাৎই আবিষ্কার করেছিলাম, বছরছয়েক আগে তার পূর্বতন মানুষটিও আমাকে একই প্রশ্ন করেছিলেন, “আমি কে? তুমি চেনো আমাকে? আমি তোমার কেউ হই?”
তখনও উত্তর দিইনি। এবারও দিইনি। উত্তর দেবার মত শক্তি অর্জন করতে আমার অনেক বছর লেগে যাবে হয়ত। কিংবা হয়ত আমি কোনোদিন এর উত্তর দিতে পারবো না।
কারণ আমি চিনি না। সত্যিই চিনি না। কেউ আমার কিছু হয় না। আমি কারও কিছু হই না। কিচ্ছু না।
৪
কাঠপুতুলের মাঝে অনুভূতি সব লুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, এটা অবশ্য খুব পুরনো কথা নয়। শৈশবে আমি এমন ছিলাম। মা বলত, এমনকি এখনও বলে, আমি ভীষণ কঠিন হৃদয়ের মানুষ। হয়ত আমি ভালোবাসার প্রাখর্যটা অনুভব করি না, করতে চাই না। মাঝে বছরখানেক হয়ত খানিকটা কোমলতা এসে ভর করেছিল। কাউকে যেতে দিতে ইচ্ছে করতো না, কাউকে আহত করতে ইচ্ছে করতো না, কাউকে বিষাদে ডুবিয়ে দিতে ইচ্ছে করতো না। এখন সব পারি। কেউ যেতে চাইলে তার যাবার পথ করে দিই, কারও আঘাতের বিনিময়ে গভীরতর আঘাতে তাকে ক্ষতবিক্ষত করি, অতল বিষাদে তার নিঃশ্বাস রোধ করে দিই। কেউ আমার কিচ্ছু না, কারও প্রতি আমার বিন্দুমাত্র মায়া নেই। যেটুকু আছে, সেটা কৃত্রিম। মায়ার ধ্বংসাবশেষ জেগে উঠতে চাইছে মাত্র। তাকে নিঃশেষ করে দিচ্ছি ক্রমশ।
কেউ আমার কিছু হয় না। আমি কারও কিছু হই না। কিচ্ছু না।