১
খুব ছোটবেলায় একবার বরিশাল থেকে ফিরবার সময় বাবার প্রবল আগ্রহে এক গণকের কাছে হাত দেখিয়েছিলাম। ভদ্রলোক খ্রিস্টধর্মাবলম্বী ছিলেন। আধপাকা ঘর, হলুদ টিমটিমে একটা বাতি জ্বলছিল, দেয়ালে যীশুখ্রিস্টের ছবি টাঙানো। বেশ কয়েকটা ছবি। কোনোটায় যীশু ক্রুশবিদ্ধ, কোনটায় মেরী, কোনটায় যীশু হাত তুলে আশীর্বাদ করছেন। আমি খুব শান্তশিষ্ট মেয়ে, বসে বসে কেবল এদিক সেদিক মাথা ঘোরাই আর চারদিকে যীশুর ছবি দেখে দেখে যখন ক্লান্ত হয়ে গেলাম তখন সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা চশমা চোখে শুভ্র চুলের ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। আমি অপরিচিত কাউকেই সহ্য করতে পারতাম না। শক্ত করে বাবার হাত আঁকড়ে ধরে রাখলাম।
প্রথমে ভদ্রলোক বাবার হাত দেখলেন, তারপর আম্মুর। কী বলেছিলেন সেসব মনে নেই। এরপরে এলো আমার পালা। নিজের ব্যাপার সবাই-ই খুব গুরুত্ব দিয়ে মনে রাখে। আমার আবছা করে একটা দৃশ্য মনে পড়ে শুধু। আবছা হলুদ আলোয় ভদ্রলোক আমার হাত ধরে একটা ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে দেখতে বললেন, “হৃদয় রেখা অত্যন্ত সুন্দর!” ব্যস, আমার আর কিছু মনে নেই।
হাত দেখা সম্পর্কে আমার স্মৃতি আপাতত এটুকুই। আমার মনে পড়ে না ভদ্রলোক আমার অশেষ দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে কিছু বলেছিলেন কি না। হৃদয় রেখা কিভাবে সুন্দর হয়, তাও জানা নেই। তবে ভদ্রলোক জানতেন না, তিনি কতখানি ভুল একটা পাঠ দিয়েছিলেন।
হাত দেখা সম্পর্কে দ্বিতীয় অভিজ্ঞতা এবং বলা চলে সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদি অভিজ্ঞতা হয়েছিল আমার কাজিনের সাথে। আমরা তখনও তিনতলায় থাকতাম। তিনতলার সিঁড়িটা আমাদের দখলেই ছিল তখনও। প্রায় সময়েই তিনতলার সিঁড়ির সবচে নিচ থেকে তিন ধাপ উপরে থেকে লাফিয়ে পড়া ছিল আমাদের সবচে মজার খেলা। আমি বরাবরই ভীতু প্রকৃতির ছিলাম। আমি যখন নতুন নতুন এই বাড়িতে আসি, তখন তারা নকল দাঁত পড়ে ড্রাকুলা সেজে আমাকে ভয় দেখাতো। আমি আগে তেমন কোনো বাচ্চার সাথে মিশিনি, বড়দের সাথে সাথে আদরে মিশে থেকেছি সবসময়। কাজেই এসব দুষ্টুমিও জানতাম না।
যাহোক, একদিন সিঁড়িতে বসে আমার ফুফাতো বোন হঠাৎ খুব গম্ভীর হয়ে এ্যাঞ্জেলাকে বলল, ‘তোমার হাতটা দাও তো!’ এ্যাঞ্জেলা এ্যারিন আপুর খুব ভক্ত ছিল। বিনা দ্বিধায় তার হাত এগিয়ে দিলো। সে খুব মনোযোগ দিয়ে দেখলো। তারপরে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “তোমার হৃদয় রেখা খুব ছোট!” তারপরে আমার হাতটা টেনে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে চুপ করে থাকলো। এ্যাঞ্জেলা সাগ্রহে জিজ্ঞেস করলো, “এ্যালানারটায় কী আছে?” এ্যারিন আপু বলল, “এ্যালানারটা সবচে বড়!” আমি বরাবরই কথা কম বলতাম। কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, “এটা ক্যামনে বুঝে?” এ্যারিন আপু ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাঁ হাতের উপরের দিকে ডান পাশ থেকে তর্জনী ছোঁয়া রেখাটা দেখিয়ে বলল, “এই দাগটা যার যত লম্বা, সে ততো ভালো, তার হৃদয় ততখানি সুন্দর!” আমি মহাখুশি!
এখনও যখনই ঘটনাটা মনে পড়ে অবচেতনে নিজের বাঁ হাতের তর্জনী ছোঁয়া রেখাটা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখি। আগের মতই আছে তো? শৈশবের নিষ্পাপ মনটাকে কোথায় ফেলে এসেছি কে জানে! কত দ্রুত আমরা বদলে যাই, বছর দশেক পরে আর নিজেদের চিনতে পারি না। আমাদের হৃদয় রেখা ক্রমশ সংকীর্ণ হতে থাকে, সংক্ষিপ্ত হতে থাকে।
২
চিনতে পারা প্রসঙ্গে হঠাৎ ‘স’ এর কথা মনে পড়লো। অনেকদিন পরে ‘স’ সেদিন ফোন দিলো। মেয়েটা কদাচিৎ ফোন দেয়, সেলফোনের খরচ খুব বেশি লাগে আমাদের। এক ঘণ্টার কমে উঠতে পারি না। অনেক অনেক খবর পেলাম। ‘ঝ’ রিইউনিয়নের ৭০ জনের টাকা নিয়ে এখন বলে রিইউনিয়ন হবে না। রূপসী মেয়েদের পড়ালেখার প্রয়োজন নেই, ইন্টার পাস হলেই ভারি ব্যালান্সের কোনো ছেলে দেখে বিয়ে করে নেবে। প্রয়োজন আমাদের মত মিডল ক্লাস মেয়েদের, যারা কারোও উপরই নির্ভরশীল থাকতে চাইনা। ‘ফ’ এখন ক্লাস বাঙ্ক দেয়, গ্রুপিং করে, যে কি না আমাদের সেকশানে ফার্স্ট গার্ল ছিল। ‘সা’ হলিক্রসে ফার্স্ট সেমিস্টারে ফেইল করে ফাইনালে তেরোতম হয়েছে। ‘মৃ’ রাইফেলসে মেয়েদের মধ্যে সিক্সথ। ‘তা’ সেলফোন না থাকায় ‘স’ কে খোঁটা দেয়। তার মতে কষ্ট করে পড়াশুনা করে কোথাও চান্স না পাওয়ার চেয়ে ৫০-৬০ লাখ টাকা খরচ করে প্রাইভেটে পড়া ভালো। ‘সা’ আর ‘রা’ এর রিলেশনশিপ ভেঙে ফেলছে ‘রা’, তার পক্ষে গোঁড়াধার্মিক কোনো ছেলের সাথে সম্পর্ক রাখা সম্ভব না। ‘ক’ আর ‘দী’ এর রিলেশন ভেঙে গেছে বলে ‘দী’ কলেজ চেঞ্জ করে ফেলেছে, ‘ক’ পড়াশুনা করে না আর, মাসের পর মাস এ্যাবসেন্ট। এই মেয়েটা আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল একসময়, তার ভাঙা অবস্থা থেকে আমি টেনে তুলেছিলাম একদিন। ফাইভে রোল ছয় ছিল। এখন আর তাকে খুঁজে পায় না কেউ।
সবকিছুর শেষে ‘স’ এর উক্তি, একমাত্র আমি আর ‘স’ একইরকম আছি। ফোন দিলেও আমাদের গল্পহীন রাজ্যে এত এত গল্প বলে আর শেষ করতে পারি না। মাঝেমাঝে কিছু সম্পর্কের কোনো বিশেষণের দরকার হয় না। অনেক দূরের বন্ধুত্বের পেছনেও অনেক গভীরতা আর নির্ভরতা থাকে। তবে অদ্ভুত লাগে এটা ভেবেই, মাত্র এক বছর হল আমরা সবাই উদয়ন থেকে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে গেছি, তার মাঝেও কত পরিবর্তন। বছর দশেক পরে কি কেউ কাউকে চিনতেও পারব?
কে জানে! তবে যে যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক। ‘স’ এর ভাষায়, যার যেদিকে মন, সেদিকেই সে যাক!
৩
আজকাল ভীষণ অস্থির লাগে। অনেক জরুরি জিনিস মনে রাখতে পারি না। নীল অপরাজিতার কথাও ভুলে যাই অনায়াসেই। সেটা এই অস্থিরতার জন্যে, ‘ভুলে যাব’- সেই বিশ্বাসের জন্যেই।
আহ, সত্যিই যদি এমন হত, ‘ভুলে যাব’ বলে এক নিমিষে ভুলে যেতে পারতাম সব বিষাদের ক্ষণগুলো, স্মৃতি থেকে লুপ্ত করে দিতে পারতাম সব অনাহুত মুহূর্তগুলো!
৪
গত সপ্তাহে আমাদের এক সহপাঠিনী আত্মহত্যা করে পৃথিবীর সাথে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দিয়েছে। আমি মেয়েটাকে চিনতাম না। পরদিন শুনেছি আমাদের মাঝের একজন উড়াল দিয়েছে সীমানা পেরিয়ে। আমি তার নামটাও জানি না। প্রথম প্রতিক্রিয়ায় খানিক বিস্ময় উঁকি দিয়ে গেছিল। তবে এক্সামের চিন্তায় সেসবকে পাত্তা দেবার সুযোগ পাইনি।
মেয়েটার অনুভূতি পরবর্তীতে ভীষণভাবে আক্রান্ত করেছিল আমাকে। একটা মানুষ কতখানি একা, আর কতখানি নিঃসঙ্গ হলে পৃথিবীর সাথে সম্পর্ক চুকিয়ে দেবার কথা ভাবতে পারে? আমার জানা নেই। আমি আত্মহত্যা করবার মত সাহসী নই। Rowling যতই বলুন, মৃত্যু ঘুমিয়ে পড়ার চেয়েও সহজ আর দ্রুত একটা প্রক্রিয়া, আমি তাতে সন্তুষ্ট নই। কোনোদিন যদি যেতে বাধ্য হই, “আক্ষরিক অর্থেই” সব হিসেব নিকেশ চুকিয়ে যাবো। একদিন বদলে দেবো সব হিসেব নিকেশ।
“মধুর ভিতর থেকে গ্রহণ করেছি আয়ু;
মৃত্যু হয়ে একদিন মিশে যাবো বিষে ।“
-নির্মলেন্দু গুণ