১
আপাতত ব্যাকগ্রাউন্ডে Rascal Flatts এর একটা গান বাজছে ফুল ভলিউমে। লিরিকের অংশবিশেষ তুলে দিলাম-
“What do I do now that you’re gone
No back up plan no second chance
And no one else to blame
All I can hear in the silence that remains
Are the words I couldn’t say”
লিরিকটার সাথে মিলবে না জানি। আজকাল নিজেকে কেমন যেন সিক্রেট কিপার টাইপের মানুষ লাগে। অন্তর্জালের কত মানুষের অন্তর্কথা তারা আমাকে শুনিয়ে গেছে নিঃশব্দ প্রহরে, আগেকার রাত্রিজাগরণের কালে। তার মাঝে হিসেব করে দেখলে খুব কম মানুষের সাথেই এখনও সুতো ছেঁড়েনি। দুয়েকজনের সাথে সুতোটা এত বেশি দৃঢ়, কখনও ছিঁড়বে বলে মনে হয় না। আবার কারো কারো সাথে সুতোটা শক্ত করে আরও দুটো বাঁধন দিতে গিয়ে ঝট করে ছিঁড়ে গেছে দৃঢ় করবার প্রচেষ্টায়। তবে একটা কথা বলতেই পারি, ওতে আমার কোনো প্রভাব ছিল না। আমি নিঃশব্দ শ্রোতামাত্র।
তবে অদ্ভুত লাগে এই ভেবে, এত বড় বড় মানুষেরা তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের স্মৃতি আমাকে শুনিয়ে কী আনন্দ পান? তাদের মনের ভার কিভাবে হালকা হয়? আমি খুব ক্ষুদ্র, খুব অপক্ব একজন মানুষ। কেউ খুব ভালো ফটোগ্রাফার। কেউ শখের লেখক, কিন্তু অসম্ভব ভালো লেখেন। কেউ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বিধাতায় অগাধ বিশ্বাস, একটু অভিমানী ধাঁচের। কেউ শিক্ষক। কেউ ফ্রিল্যান্সার। লেখকরাই বেশি। আমার সাথে শখের লেখকদের যোগসূত্র বেশি। কারও পুরনো প্রেমের গল্প, তাকে হারাবার গল্প, তাকে হারিয়ে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতি অনবদ্য শব্দসঞ্চারে লেখায় তুলে দেয়া, সব আমার জানা। আমার জানা লেখকের পুরনো প্রেমের গল্পও, কলেজের গল্প, তার স্মরণে করা স্মৃতিচারণ, যাকে তিনি প্রকৃত রূপে উপস্থাপনের সাহস করেননি, গল্পের চরিত্ররূপে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তবু বেশ সুখপাঠ্য। কিংবা কারও পারিবারিক প্রকট দ্বন্দ্বের গল্প। কারও বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতা। পরিবারে নতুন কোনো সম্পর্ক সংক্রান্ত জটিলতা। কেউবা আবার প্রিয়তম মানুষের প্রতারণায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে খুঁজছেন নতুন কারো কাছে থিতু হবার মত আশ্রয়।
সবার এত এত গল্প। জীবনের গল্প। শুনতে নেহাৎ মন্দ লাগে না। অন্তর্জালের এই দূরত্বের পরিচয়ের এটা বোধহয় খুব ভালো একটা প্রয়োগ। স্বল্পপরিচিত কোনো মানুষের কাছে মন খুলে দেওয়া। প্রথমত, সেটা প্রকাশের কোনো ভয় থাকে না, অপরিচিত হবার কারণে; দ্বিতীয়ত, এত বছর ধরে বহন করে যাওয়া মনের ভার নেমে যেতে থাকে। অন্তত দু একটা রাত নির্ঘুম থাকবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
এই মানুষগুলোর অনেকের সাথেই আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। হয়ত কোনো তুচ্ছ বিষয়ে মতবিরোধে আমি তাদের সরিয়ে দিয়েছি, কিংবা তাঁরাই আমাকে সরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা চলে গেছেন, তাদের গল্পগুলো আমার কাছে জমা রেখে। একটা গল্পের একটা শব্দও আমি ভুলিনি। আমার সবকিছু মনে থাকে। সবকিছু।
প্রায় সবকিছু।
২
আমার অবশ্য এরকম মন খুলে দেবার মত এত এত মানুষের প্রয়োজন নেই। আমার মন খুলে দেওয়াই আছে কাঠপুতুলের কাছে। নৈঃশব্দের ভাষাটাও তার জানা, আমার জানা। তবু আমার অনেক অনেক গল্প আছে। তার অনেক কিছুই আমি কাউকে বলিনি কখনো। নিঃশব্দ শ্রোতাদের কথা শুনবার জন্যে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না!
মাঝে কনফেশান পেজের হুল্লোড় পড়ে গেছিল ফেসবুকে। প্রথম প্রথম মজাই লাগতো। আস্তে আস্তে বিরক্ত লাগতে শুরু করলো সবার। অন্যের কথা শুনতে বেশিরভাগেরই ভালো লাগে না। আমিও খানিকটা সেই ধরনেরই মানুষের। তবুও কিছু কিছু মানুষের গল্প এত মর্মস্পর্শী হয়, কেবলই শুনতে ইচ্ছে করে।
৩
ফেসবুকে এখন অনেক গল্পবলিয়ে। মাজহার মিথুন নামের একজনের গল্গগুলো পড়ে ভালো লেগেছিল। ফলো করলাম। প্রায় প্রতিদিনই একটা গল্প। এত এত সুন্দর গল্প অনেকদিন পড়িনি অন্তর্জালে। গল্পবলিয়েরও অবশ্য শ্রেণীভেদ আছে। কেউ নেহাৎই প্রতিদিনকার গল্পকে শব্দের কারুকার্যে সাজিয়ে তুলে দেন দেয়ালে, কেউ কল্পনার জগতকে শব্দে রূপ দিয়ে সাজিয়ে দেন, কেউ আবার গুরুগম্ভীর হয়ে বসে যান গুরুতর সাহিত্যসাধনা করতে!
আমার ছোট্টবেলার সবচে প্রিয় গল্পবলিয়ে ছিল আমার দাদির গৃহপরিচারিকারা। শৈশব কাটিয়েছি আলাদা বাড়িতে। ১৯৯৯ তে বোধহয় এই বাড়িতে উঠে আসি। অপরিচিত মানুষদের খুব ভয় পেতাম। আমার মনে আছে, কল্যাণপুর এগারো নম্বর রোডের এক তলায় থাকতাম আমরা। ওই বাড়িতে প্রায়ই অদূরের বস্তির ছেলেমেয়েরা ময়লা তুলতে আসতো। চুরিও করতো। জানলা দিয়ে উঁকি দেওয়া মুখগুলো দেখলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠতাম। অচেনা কাউকে একেবারেই সহ্য হত না। নতুন বাড়িতে এসেও এতসব এতদিনের অচেনা মানুষগুলো দেখে দিশেহারা হয়ে গেলাম। কাজিনদের ভালো লাগতো না, কাজিনরাও আমাকে বিশেষ পছন্দ করতো না কথা বলতে চাইতাম না বলে, মিশুক নই বলে। আমার সখ্য গড়ে উঠল রান্নাঘরের বাসিন্দাদের সাথে। যদিও আমার দাদি-ফুপু এটাকে মোটেও পছন্দ করতেন না।
পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতাম রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দিতাম। বাড়ির রেওয়াজ ছিল গৃহপরিচারিকাদের নাম যদি পরিবারের কারও নামের সাথে মিলে যায়, তাকে একটা নতুন নাম দিয়ে দেওয়া হত। একজনের নাম ছিল কবিতা, মিলে যাওয়ায় তার নাম হয়ে গেল নাজমা। এরকম করে পারুল, সাজু, তানিয়া আরও বেশ কয়েকজন। তারাও আমাকে নেহাৎ অপছন্দ করতো না। আমি চুপচাপ রান্নাঘরের দরজার পাশে পিঁড়িতে বসে তাদের বাড়ির গল্প শুনতাম। কোন ফুপু তাদের কি কারণে বকেছে সেইসব শুনতাম। পারুল নামের মেয়েটা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল। কথার মাঝে মাঝেই আমার চিবুক ছুঁয়ে বলত, “গিয়া বইলা দিবা না তো?” বিকেলে ছাদে আমার খেলার সাথীও ছিল তারা। আমার কাজিনরা ভারী অহঙ্কারি ছিল। আমার ভালো লাগতো না। তারচে পারুল-নাজমা’দের স্নেহটা আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান মনে হত।
এরপরে যখন এক ছাদের নিচে থেকেও সব আলাদা হয়ে গেল, তখন আমাদের নিজস্ব গৃহপরিচারিকা এলো, আমার সদ্যোজাত ভাইকে দেখাশোনা করবার জন্যে। নাম রুমা। পুরো নাম বোধহয় ফাতেমা পারভীন ধরনের কিছু ছিল। ভারি রূপসী ছিল মেয়েটা, সেইসাথে পড়াশুনোও জানতো। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। মায়ের সাথে মন কষাকষি হওয়ায় চলে এসেছিল কাজ করতে। প্রথম দিন ওকে দেখে আমার এত্ত হাসি পেয়েছিল কেন জানি না। প্রথম কথাটা বলেছিলাম আমি, একটা পানির গ্লাস দেখিয়ে, ‘এটা তোমার গ্লাস, ঠিকাছে?” আমি তখন কেজিতে পড়ি।
সেটা নিয়ে রুমা অনেকদিন ঠাট্টা করেছিল। রুমা ছিল আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমি, রুমা আর আমার ভাই। আমার নিজস্ব কোনো রুম ছিল না। বেডরুম লাগোয়া একটা বারান্দামতন জায়গায় পড়ার টেবিল আর কিচেন শেলফ ছিল তখন। দুপুরে প্রচণ্ড রোদে তপ্ত হয়ে উঠত ঘরটা। তার মাঝেই পড়তাম আমি। জানলায় পর্দা ছিল না বলে মাদুর পেতে রোদ আটকাতাম জানলায়।
একদিন সেখানে বসে রুমার সে কি কান্না! প্রশ্ন করতেই আমার দিকে অভিমানভরা চোখে তাকিয়ে বলল, “তুমি সকাল থেকে আমাকে ও ও করে কথা বললা ক্যান? আমার কষ্ট লাগে না?” তখন আমি ওয়ানে উঠলাম মাত্র। রুমার বয়স প্রায় আঠারো।
রুমা সবশেষে পালিয়েছিল পাশের বিল্ডিং অফিসের এক ছেলের সাথে। তার আগের এক ঈদে ছাদে উঠেছিলাম আমরা। আমি লাফাতে লাফাতে বললাম, “আজকে চাঁদ উঠলে কালকে ঈদ! কি মজা!” রুমা ম্লানমুখে একটু হেসে বলল, “আমার তো ঈদ নাই কোনো!”
রুমার গল্প এখানেই শেষ। এরপরে রুমা আর ফেরেনি। মাঝে একবার তার মা এসে তাকে বাড়ি নিয়ে গেছিল। রুমা জোর করে পালিয়ে এসেছিল, বলেছিল, “তোমাদের দুইজনকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না”। সেই রুমা অন্যের হাত ধরে পালিয়ে গেল।
এরপর আচমকা সে একদিন হাজির হল আবার। প্রায় বছর আটেক পর। কোলে এক শিশুপুত্রকে নিয়ে।
সেসব নিয়ে আর কিছু লিখবো না। আমার পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে থাকতেই বেশি ভালো লাগে।
এইসব যোগসূত্র কেটে যাওয়ার মানুষদের মত।
আমার চাপা দেয়া গল্পগুলোর শ্রোতা কেবলই কাঠপুতুল। সত্যিই, সবারই একবার না একবার মন হালকা করবার জন্যে চাপা দেওয়া স্মৃতিগুলো প্রকাশ করে দেবার প্রয়োজন হয়। নয়ত স্মৃতিগুলো বোঝার মত চেপে বসে। আমার অনেক অনেক গল্প। সময় পেলে আস্তে আস্তে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবো কাঠপুতুলের শুনবার জন্যে।
ভালো থাকুক সব ছিন্নসূত্রের মানুষেরা।