আকাঙ্ক্ষা


একটা সারাদিন কিছুই করবনা আমরা,
না কিছুই না।।

হয়তো সারাটাদিন আমরা পাশাপাশি
বসে থাকব,অনন্তকালের মতো ।।

হয়তো আবার একাও থাকবো,
কিন্তু সত্যি বলছি একটা সম্পূর্ণ দিন আমরা কিছুই
করবনা।।এই হেমন্তে যে নদী মৃত্যুর প্রস্তুতি নেবে
আগামী শীতের,তার মতো আমরাও প্রস্তুত হবো
আমাদের একটা সারাদিনের জন্যে, এই হেমন্তে।।

কে জানে বলো;
আগামী শীতে হয়তো আমরা থাকবনা।।

নির্মলেন্দু গুণের এই কবিতাটা পেলাম নিউজ ফিডে। কেন যেন সবকিছুতেই তোমার ছায়া পড়ে। মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষদের কাছ থেকে প্রাপ্য সময়টুকু না পেয়ে ভাবি, কোনো একদিন সবচেয়ে প্রিয় মানুষটি আমাকে নিরাশ করবে না। নেহাৎ অভিমানের কিছু শব্দাবলি মনের এ কোণ থেকে ও কোণ ঘুরে বেড়ায়। এলোমেলো শব্দাবলি সব। এরপর থেকে হয়ত এই কবিতাটা আওড়াবো। অভিমানের কবিতা। কবিতার শিরোনামটা জানা নেই…আমি নাম দিলাম অভিমানের কবিতা।

‘প্রাপ্য’ শব্দেরও কিছু শ্রেণীভেদ আছে। আমার কাছে যেটা প্রাপ্য, সেটা হয়ত অন্য কারও কাছে প্রদেয় না-ও হতে পারে। কিংবা অন্যের কাছে যা আকাঙ্ক্ষিত নয়, সেটা আমি তাকে জোর করে দিতেও পারি। প্রশ্ন হল, আমি কী চাই?

সময়, সময় এবং সময়! সবচে দুর্লভ জিনিসটাই আমার একমাত্র আকাঙ্ক্ষা।

এইসব ব্যস্ততা


ছোটখাট কিছু লিখতে ইচ্ছে করছে। অভিমান কিংবা নেহাৎ জমা থাকা কিছু বিষাদের কথা। প্রতিদিন কতশত কথা বলা হয়, শোনা হয়, বুঝতে চেষ্টা করা হয়, কিংবা কেবলই এড়িয়ে যাওয়া হয়, তার থেকে দুটো শব্দ সাজিয়ে দিতে চাই।

ফেসবুকে গতকাল একজনের বিষাদ-কণ্ঠ শুনলাম। কারণটা আমার মতই, সময় চেয়েও না পাওয়া। আমি ঠিক জানি না, সবার মাঝেই এই বিষাদটা কাজ করে কি না। করলেও তার মাত্রাভেদের ঠিক কতটুকু পার্থক্য হয় যে, ওপাশের মানুষটির এই হতাশা আমাদের স্পর্শ করে না? নাকি এটা কেবলই কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা দেবার সময়কার কিছু কুয়াশা, যা কেবলই দ্বিধান্বিত করতে চায় প্রিয় মানুষদের নিয়ে? জানা নেই! কিচ্ছু জানা নেই!

তবে আমি ভেবে নিয়েছি আমি কখনও ব্যস্ত হবো না। অবশ্য আমি ব্যস্ত হলেও কারো কিছু এসে যাবে বলে মনে হয় না। যে যখন যেভাবে চেয়েছে, সেভাবে তার সহযাত্রী হতে চেয়েছি। বিনিময় চাইনি। চেয়েছিলাম শুধু বছরে অন্তত তিনটে দিন প্রশ্ন করুক, ‘কেমন আছিস?’

এসব নেহাৎই বাতুলতা। এখন বুঝি। এখন জানি, কিভাবে এড়িয়ে যেতে হয় সবকিছুকে। কিভাবে ‘না’ বলতে হয়। কিভাবে বলা যায়, ‘পারবো না’। সাথে শিখে নিয়েছি ‘দুঃখিত’ বলবার সময় কণ্ঠ কিভাবে কৃত্রিমভাবে অনুতপ্ত করে তুলতে হয়। বেঁচে থাকার জন্যে এসবের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম।

দুর্ঘটনার পরে প্রথমবার খুব খাটুনি গেল গত পরশু। আমার মাছবন্ধুদের ঘরবাড়ি সাজালাম নতুন করে। প্রচণ্ড ব্যস্ত হয়ে পড়বো সামনের কিছু দিন। ওপরের শব্দমালার সাথে ব্যতিক্রম? নাহ, প্রিয় মানুষদের জন্যে আমার সময়ের কখনই অভাব হবে না। আমি কক্ষণোও ব্যস্ত হবো না।

আগে খুব ভাবতাম এসব নিয়ে। এখন কেবলই হাওয়ায় উড়িয়ে দিই এইসব জমা থাকা বিষাদ। অবহেলার প্রত্যুত্তর দিতেও ইচ্ছে করে না। মাঝেমধ্যে কাঠপুতুলকে শোনাই। যখন খুব বেশি বিষাদ জমে যায়, তখন। ব্যস্ত মানুষদের এত কিছু শুনবার সময় কোথায়? শোনাবারও ইচ্ছে নেই…

খুব অল্প সময়ের ব্যবধানের মানুষ খুব বদলে যায়। কেবল আমাদের মত কিছু বোকামানুষেরা বদলাতে পারে না। ক্ষতবিক্ষত খোলসে মুখ লুকিয়ে বদলে যাওয়াদের এই পরিবর্তনকে ভিন্নভাবে দেখতে চায়। ন’ সেদিন আমার হুটহাট ঘুমাতে যাওয়া দেখে বলে ফেলল, ‘তুই ত দিন দিন রোবোটের মত হয়ে যাচ্ছিস! যখন তখন সুইচ বন্ধ করে দিস!”

আমার চেনা পরিচিত মানুষেরাও এমন হয়ে যাচ্ছে। রোবোটের মত। প্রয়োজনের সময় মায়ার বাঁধন ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে। বাঁধনটা কি বোঝার মত বোধ হয় তাদের? আমি কবে এমন করে বাঁধন ছিঁড়ে যাওয়া শিখবো? কবে?

পাপে-পুণ্যে এ পৃথিবী, এই প্রাণ তারচে অধিকে ।
আমি আছি, তুমি নেই–,এইভাবে দু’জন দু’দিকে
অপসৃত; -তাই তো নশ্বর নারী কবির বিশ্বাসে,
ভালোবেসে যাকে ছুঁই, সেই যায় দীর্ঘ পরবাসে…।

-নির্মলেন্দু গুণ

যাকে উদ্দেশ্য করে লিখলাম, তার চোখে পড়বে কি?

যে গল্পের শ্রোতা কেবলই কাঠপুতুল…



আপাতত ব্যাকগ্রাউন্ডে Rascal Flatts এর একটা গান বাজছে ফুল ভলিউমে। লিরিকের অংশবিশেষ তুলে দিলাম-
“What do I do now that you’re gone
No back up plan no second chance
And no one else to blame
All I can hear in the silence that remains
Are the words I couldn’t say”

লিরিকটার সাথে মিলবে না জানি। আজকাল নিজেকে কেমন যেন সিক্রেট কিপার টাইপের মানুষ লাগে। অন্তর্জালের কত মানুষের অন্তর্কথা তারা আমাকে শুনিয়ে গেছে নিঃশব্দ প্রহরে, আগেকার রাত্রিজাগরণের কালে। তার মাঝে হিসেব করে দেখলে খুব কম মানুষের সাথেই এখনও সুতো ছেঁড়েনি। দুয়েকজনের সাথে সুতোটা এত বেশি দৃঢ়, কখনও ছিঁড়বে বলে মনে হয় না। আবার কারো কারো সাথে সুতোটা শক্ত করে আরও দুটো বাঁধন দিতে গিয়ে ঝট করে ছিঁড়ে গেছে দৃঢ় করবার প্রচেষ্টায়। তবে একটা কথা বলতেই পারি, ওতে আমার কোনো প্রভাব ছিল না। আমি নিঃশব্দ শ্রোতামাত্র।

তবে অদ্ভুত লাগে এই ভেবে, এত বড় বড় মানুষেরা তাদের ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখের স্মৃতি আমাকে শুনিয়ে কী আনন্দ পান? তাদের মনের ভার কিভাবে হালকা হয়? আমি খুব ক্ষুদ্র, খুব অপক্ব একজন মানুষ। কেউ খুব ভালো ফটোগ্রাফার। কেউ শখের লেখক, কিন্তু অসম্ভব ভালো লেখেন। কেউ কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার, বিধাতায় অগাধ বিশ্বাস, একটু অভিমানী ধাঁচের। কেউ শিক্ষক। কেউ ফ্রিল্যান্সার। লেখকরাই বেশি। আমার সাথে শখের লেখকদের যোগসূত্র বেশি। কারও পুরনো প্রেমের গল্প, তাকে হারাবার গল্প, তাকে হারিয়ে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতি অনবদ্য শব্দসঞ্চারে লেখায় তুলে দেয়া, সব আমার জানা। আমার জানা লেখকের পুরনো প্রেমের গল্পও, কলেজের গল্প, তার স্মরণে করা স্মৃতিচারণ, যাকে তিনি প্রকৃত রূপে উপস্থাপনের সাহস করেননি, গল্পের চরিত্ররূপে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। তবু বেশ সুখপাঠ্য। কিংবা কারও পারিবারিক প্রকট দ্বন্দ্বের গল্প। কারও বিয়ে সংক্রান্ত জটিলতা। পরিবারে নতুন কোনো সম্পর্ক সংক্রান্ত জটিলতা। কেউবা আবার প্রিয়তম মানুষের প্রতারণায় ক্ষতবিক্ষত হৃদয়ে খুঁজছেন নতুন কারো কাছে থিতু হবার মত আশ্রয়।

সবার এত এত গল্প। জীবনের গল্প। শুনতে নেহাৎ মন্দ লাগে না। অন্তর্জালের এই দূরত্বের পরিচয়ের এটা বোধহয় খুব ভালো একটা প্রয়োগ। স্বল্পপরিচিত কোনো মানুষের কাছে মন খুলে দেওয়া। প্রথমত, সেটা প্রকাশের কোনো ভয় থাকে না, অপরিচিত হবার কারণে; দ্বিতীয়ত, এত বছর ধরে বহন করে যাওয়া মনের ভার নেমে যেতে থাকে। অন্তত দু একটা রাত নির্ঘুম থাকবার যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।

এই মানুষগুলোর অনেকের সাথেই আমার আর কোনো যোগাযোগ নেই। হয়ত কোনো তুচ্ছ বিষয়ে মতবিরোধে আমি তাদের সরিয়ে দিয়েছি, কিংবা তাঁরাই আমাকে সরিয়ে দিয়েছেন। তাঁরা চলে গেছেন, তাদের গল্পগুলো আমার কাছে জমা রেখে। একটা গল্পের একটা শব্দও আমি ভুলিনি। আমার সবকিছু মনে থাকে। সবকিছু।

প্রায় সবকিছু।


আমার অবশ্য এরকম মন খুলে দেবার মত এত এত মানুষের প্রয়োজন নেই। আমার মন খুলে দেওয়াই আছে কাঠপুতুলের কাছে। নৈঃশব্দের ভাষাটাও তার জানা, আমার জানা। তবু আমার অনেক অনেক গল্প আছে। তার অনেক কিছুই আমি কাউকে বলিনি কখনো। নিঃশব্দ শ্রোতাদের কথা শুনবার জন্যে কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না!

মাঝে কনফেশান পেজের হুল্লোড় পড়ে গেছিল ফেসবুকে। প্রথম প্রথম মজাই লাগতো। আস্তে আস্তে বিরক্ত লাগতে শুরু করলো সবার। অন্যের কথা শুনতে বেশিরভাগেরই ভালো লাগে না। আমিও খানিকটা সেই ধরনেরই মানুষের। তবুও কিছু কিছু মানুষের গল্প এত মর্মস্পর্শী হয়, কেবলই শুনতে ইচ্ছে করে।


ফেসবুকে এখন অনেক গল্পবলিয়ে। মাজহার মিথুন নামের একজনের গল্গগুলো পড়ে ভালো লেগেছিল। ফলো করলাম। প্রায় প্রতিদিনই একটা গল্প। এত এত সুন্দর গল্প অনেকদিন পড়িনি অন্তর্জালে। গল্পবলিয়েরও অবশ্য শ্রেণীভেদ আছে। কেউ নেহাৎই প্রতিদিনকার গল্পকে শব্দের কারুকার্যে সাজিয়ে তুলে দেন দেয়ালে, কেউ কল্পনার জগতকে শব্দে রূপ দিয়ে সাজিয়ে দেন, কেউ আবার গুরুগম্ভীর হয়ে বসে যান গুরুতর সাহিত্যসাধনা করতে!

আমার ছোট্টবেলার সবচে প্রিয় গল্পবলিয়ে ছিল আমার দাদির গৃহপরিচারিকারা। শৈশব কাটিয়েছি আলাদা বাড়িতে। ১৯৯৯ তে বোধহয় এই বাড়িতে উঠে আসি। অপরিচিত মানুষদের খুব ভয় পেতাম। আমার মনে আছে, কল্যাণপুর এগারো নম্বর রোডের এক তলায় থাকতাম আমরা। ওই বাড়িতে প্রায়ই অদূরের বস্তির ছেলেমেয়েরা ময়লা তুলতে আসতো। চুরিও করতো। জানলা দিয়ে উঁকি দেওয়া মুখগুলো দেখলেই চিৎকার করে কেঁদে উঠতাম। অচেনা কাউকে একেবারেই সহ্য হত না। নতুন বাড়িতে এসেও এতসব এতদিনের অচেনা মানুষগুলো দেখে দিশেহারা হয়ে গেলাম। কাজিনদের ভালো লাগতো না, কাজিনরাও আমাকে বিশেষ পছন্দ করতো না কথা বলতে চাইতাম না বলে, মিশুক নই বলে। আমার সখ্য গড়ে উঠল রান্নাঘরের বাসিন্দাদের সাথে। যদিও আমার দাদি-ফুপু এটাকে মোটেও পছন্দ করতেন না।
পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত হয়ে যেতাম রান্নাঘরে গিয়ে উঁকি দিতাম। বাড়ির রেওয়াজ ছিল গৃহপরিচারিকাদের নাম যদি পরিবারের কারও নামের সাথে মিলে যায়, তাকে একটা নতুন নাম দিয়ে দেওয়া হত। একজনের নাম ছিল কবিতা, মিলে যাওয়ায় তার নাম হয়ে গেল নাজমা। এরকম করে পারুল, সাজু, তানিয়া আরও বেশ কয়েকজন। তারাও আমাকে নেহাৎ অপছন্দ করতো না। আমি চুপচাপ রান্নাঘরের দরজার পাশে পিঁড়িতে বসে তাদের বাড়ির গল্প শুনতাম। কোন ফুপু তাদের কি কারণে বকেছে সেইসব শুনতাম। পারুল নামের মেয়েটা দেখতে ভারি সুন্দর ছিল। কথার মাঝে মাঝেই আমার চিবুক ছুঁয়ে বলত, “গিয়া বইলা দিবা না তো?” বিকেলে ছাদে আমার খেলার সাথীও ছিল তারা। আমার কাজিনরা ভারী অহঙ্কারি ছিল। আমার ভালো লাগতো না। তারচে পারুল-নাজমা’দের স্নেহটা আমার কাছে অনেক বেশি মূল্যবান মনে হত।

এরপরে যখন এক ছাদের নিচে থেকেও সব আলাদা হয়ে গেল, তখন আমাদের নিজস্ব গৃহপরিচারিকা এলো, আমার সদ্যোজাত ভাইকে দেখাশোনা করবার জন্যে। নাম রুমা। পুরো নাম বোধহয় ফাতেমা পারভীন ধরনের কিছু ছিল। ভারি রূপসী ছিল মেয়েটা, সেইসাথে পড়াশুনোও জানতো। ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিল। মায়ের সাথে মন কষাকষি হওয়ায় চলে এসেছিল কাজ করতে। প্রথম দিন ওকে দেখে আমার এত্ত হাসি পেয়েছিল কেন জানি না। প্রথম কথাটা বলেছিলাম আমি, একটা পানির গ্লাস দেখিয়ে, ‘এটা তোমার গ্লাস, ঠিকাছে?” আমি তখন কেজিতে পড়ি।

সেটা নিয়ে রুমা অনেকদিন ঠাট্টা করেছিল। রুমা ছিল আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমি, রুমা আর আমার ভাই। আমার নিজস্ব কোনো রুম ছিল না। বেডরুম লাগোয়া একটা বারান্দামতন জায়গায় পড়ার টেবিল আর কিচেন শেলফ ছিল তখন। দুপুরে প্রচণ্ড রোদে তপ্ত হয়ে উঠত ঘরটা। তার মাঝেই পড়তাম আমি। জানলায় পর্দা ছিল না বলে মাদুর পেতে রোদ আটকাতাম জানলায়।

একদিন সেখানে বসে রুমার সে কি কান্না! প্রশ্ন করতেই আমার দিকে অভিমানভরা চোখে তাকিয়ে বলল, “তুমি সকাল থেকে আমাকে ও ও করে কথা বললা ক্যান? আমার কষ্ট লাগে না?” তখন আমি ওয়ানে উঠলাম মাত্র। রুমার বয়স প্রায় আঠারো।

রুমা সবশেষে পালিয়েছিল পাশের বিল্ডিং অফিসের এক ছেলের সাথে। তার আগের এক ঈদে ছাদে উঠেছিলাম আমরা। আমি লাফাতে লাফাতে বললাম, “আজকে চাঁদ উঠলে কালকে ঈদ! কি মজা!” রুমা ম্লানমুখে একটু হেসে বলল, “আমার তো ঈদ নাই কোনো!”

রুমার গল্প এখানেই শেষ। এরপরে রুমা আর ফেরেনি। মাঝে একবার তার মা এসে তাকে বাড়ি নিয়ে গেছিল। রুমা জোর করে পালিয়ে এসেছিল, বলেছিল, “তোমাদের দুইজনকে ছাড়া থাকতে ভালো লাগে না”। সেই রুমা অন্যের হাত ধরে পালিয়ে গেল।

এরপর আচমকা সে একদিন হাজির হল আবার। প্রায় বছর আটেক পর। কোলে এক শিশুপুত্রকে নিয়ে।
সেসব নিয়ে আর কিছু লিখবো না। আমার পুরনো স্মৃতি আঁকড়ে থাকতেই বেশি ভালো লাগে।
এইসব যোগসূত্র কেটে যাওয়ার মানুষদের মত।

আমার চাপা দেয়া গল্পগুলোর শ্রোতা কেবলই কাঠপুতুল। সত্যিই, সবারই একবার না একবার মন হালকা করবার জন্যে চাপা দেওয়া স্মৃতিগুলো প্রকাশ করে দেবার প্রয়োজন হয়। নয়ত স্মৃতিগুলো বোঝার মত চেপে বসে। আমার অনেক অনেক গল্প। সময় পেলে আস্তে আস্তে সাজিয়ে গুছিয়ে দেবো কাঠপুতুলের শুনবার জন্যে।

ভালো থাকুক সব ছিন্নসূত্রের মানুষেরা।

এইসব গল্পেরা…


কাল রাত থেকেই অবিরাম বৃষ্টি হচ্ছে। তার প্রতি অবহেলা দেখিয়ে পড়ায় মন দিলাম। প্রচুর পড়া জমে আছে। সেকেণ্ড সেমিস্টারের পরে কিছুতেই যেন মন বসাতে পারছি না। পড়াতে তো একেবারেই না। একটু পড়ার পরেই মাথা ধরে যায়। মাথা জিনিসটা ভারী অদ্ভুত। হৃদয় নিয়ে এত এত কাব্য হল, তবু দ্যাখো, মাথার ঐ ছোট্ট মাংসপিণ্ডটাই সবকিছুর নিয়ন্ত্রণে। এর মাঝে আবার বায়োলজি এনো না!

আজকাল রাতে আর ঘুম হয় না। একা একা জেগে থাকতেও কি ভয়াবহ কষ্ট! একসময় তো থাকতাম, কোনো অনুভূতিও হত না। বড় হতে হতে কতরকম অনুভূতি যে আমাদের মাঝে জন্ম নেয়! অবশ্য ব্যস্ত থাকি সারারাতই, জটিল কোনো সমীকরণ, গাছপালার ভেতরের অদৃশ্য সব কার্যকলাপ, রেডিয়ামের ক্রোধ বা অলিয়ামের দুষ্টুমির কারণ বুঝতে বুঝতে রাত পেরিয়ে যায়। কথা বলার মানুষ থাকলেও হয়ত তাকে সেভাবে সময় দিতে পারতাম না। আর জানোই তো, আমার এমনটা স্বভাব, কিছু পাওয়ার পরে তার প্রতি একেকসময় ভারি বিরক্ত লাগে!

রাতে মাঝেমাঝে ‘বড় হাতি’পুর সাথে কথা হচ্ছিল। স্বীকারোক্তি লেখাটা পড়ে বলল, আমি নাকি ডিম ফুটে বেরিয়ে আসছি! আমি ত ম্যাঁও, ডিমের ভেতর ঢুকলামই বা কিভাবে, আর বেরোলামই বা কিভাবে!

যাকগে, পরশু সন্ধ্যে থেকে প্রচণ্ড মাথাব্যথা হচ্ছিল। ভাবলাম পড়াশুনো নিয়ে দুশ্চিন্তায় হয়তবা। শেষে থাইরয়েডের ওষুধ খাওয়ার পরে দুই-ই সমাধান হল। আমি তাকে ছাড়তে চাইলেও সে আমাকে ছাড়বে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে হয়ত! সপ্তাহদুয়েক বাদ গিয়েছিল, এক্সাম আর পড়াশোনার ব্যস্ততায় ভুলেই গেছিলাম। মনে হচ্ছে, আজীবন এর ওপরে নির্ভর করে থাকতে হবে। মাঝেমধ্যে অন্য কোনো অসুখের ট্রিটমেন্ট নিতে গেলে সে একটু চোটপাট দেখিয়ে অল্টারনেটিভ ট্রিটমেন্ট করাতে বাধ্য করবে। দুরারোগ্য ব্যাধি যেন!

অবশ্য আমরা সবাই-ই কোনো না কোনোভাবে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত। কেউ ঈর্ষা, কেউ ক্রোধ, কেউ জেদ, কেউ ঘৃণা! এইসব অসুখের চিকিৎসা আছে কোনো?

বৃষ্টি থেমে আসছে। সারাদিন বৃষ্টি হলে বেশ হতো।

একটা সময় রোদ্দুরকে কি ভীষণভাবে ভালোবাসতাম! এখনও মনে আছে, এসএসসি দেবার সময়, এক্সাম শেষ করে ছায়ায় দাঁড়াইনি কোনোদিন, হালকা রোদ পড়ে, এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছি। ছাতাকে নিশ্চিন্তে ঘুমোতে দিয়েছি ব্যাগের কোণে। কেন যেন রোদ্দুর ভালো লাগতো খুব। এখন আর লাগে না। এমন ক্রুদ্ধ রোদ্দুর ভালো লাগে কারো? যদি আবার কখনও লক্ষ্ণী হয়ে আসে, তবে ভেবে দেখা যেতে পারে!

সকালে সুনীলের পূর্ব পশ্চিম পড়ছিলাম। শেষের দিকে এসে পড়েছি, উপসংহার চ্যাপ্টারটা পড়ছি। সুনীলের চরিত্রাঙ্কন আর কথোপকথনের কৌশলটা ভারি ভালো লাগে। তবে বলা বাহুল্য, প্রথম আলো পড়ে যতটা মুগ্ধ হয়েছিলাম, সেই সময় পড়ে তারচে কিছু কম, আর পূর্ব পশ্চিম পড়ে তারচে কিছু কম মুগ্ধতা এসেছে। তাই বলে ভেবো না, পূর্ব পশ্চিম বা সেইসময় তেমন ভালো না। আমার সাহিত্যজ্ঞান আসলে তেমন ভালো নয়। বুঝিও কম। পূর্ব পশ্চিম পড়ে অতীনের ওপর ভারি রাগ হয়েছে। এতটা নিষ্ঠুর কেমন করে হয় মানুষ!

ছোট্ট একরত্তি জীবন, তার মাঝে কত জেদ-অভিমান-ভুলবুঝাবুঝি! ‘বড় হাতি’পুও বলছিল কাল, ডিম ফুটে বেরোলেও আমার তেজ-জেদ সব একই রয়ে গেছে।

থাকুক। আমি জটিল কোনো মানুষ হতে চাই না। জেদ-অভিমানে বেলা কাটানো অবুঝই থাকতে চাই

বেঁচে থাকুক অভিমানেরা।

 

 

খামবন্দি অনুভূতি : মায়া ও স্বার্থপরতার কথা


প্রিয় রোদ্দুর,

কখনও এমন হয় আশেপাশের কাউকে আমরা এত বেশি আপন ভেবে ফেলি, তাদেরকে খাঁচাবন্দি করে ফেলি। আটকে ফেলি। কোত্থাও যেতে দিতে চাই না। কেমন যেন মায়ামাখানো স্বার্থপরতা! দেখো, স্বার্থপরতা কত বাজে জিনিস, তবুও তার সাথে মায়া মিশে গেলে, হয়ত সেটাও আমাদের আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। আমরা কেউ কেউ সেই মায়ামাখানো স্বার্থপরতা দেখিয়ে যাই, আর অপর পাশের মানুষটাও সেই স্বার্থপরতাটাকে উপভোগ করে, খুব বেশিদিনের পরিচয়, কিংবা পারস্পরিক মায়াটা খুব বেশি হয়ে গেলে হয়ত খানিকটা অসহায়ভাবে খাঁচার দরোজা খুলে পালিয়ে যেতে চায়। পালাতে গিয়ে আটকে পড়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জালে। “যাবো? এত মায়া ছেড়ে কোথায় যাবো?” কিংবা “ওর মন ভেঙে যাবে! ওতে কি আমার সুখ হবে?” সবশেষে, “নাহ, আমি যাবোই। কারও মায়ার বাঁধনে আমি বাধা পড়তে রাজি নই। তাও এমন স্বার্থমাখানো মায়া!” কিংবা, “থাক, অতটুকু মায়াও একসময় হয়ত আর আমার জন্যে জমা থাকবে না। যদ্দিন আছে, ততদিন না হয় থাকি…”

কি জানি! আমি অমন মায়ার বাঁধনে আটকা পড়েছি বহুবার। তবে প্রতিবারই মায়াময় মানুষগুলো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই আমাকে মুক্ত করে দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা সেইসব মানুষদের প্রতি…

তারপর আমি ছন্নছাড়া পাখির মত উড়ে বেড়াই। অন্যের ঘরে খানিক সময়ের জন্যে আশ্রয় নিই। আবার পালাই, কিছু না জানিয়ে। কিন্তু শেষবার আবার ধরা পড়লাম। খুব ভালোভাবেই ধরা পড়লাম। এখন পর্যন্ত ছেড়ে দেবার নাম করছে না।  সম্ভবত করবেও না। কে জানে! মানুষের মন…। হয়ত দেখা যাবে কোনো এক বিষাদী রাতে খাঁচা খুলে বলবে, “যাও! মুক্ত করে দিলাম তোমায়!” কী করব আমি তখন? উড়ে যাবো খুশিমনে? নাকি তখন নিজেই নিজেকে জোর করে খাঁচার ভেতর আটকে রাখবো। তার খাঁচা থেকে মুক্ত হতে চাইবো না? হতেও পারে!

ভাবছো, আমি, যে কি না, বারবার মুক্ত হয়ে উড়ে যেতে চেয়েছি, সে কেন নিজেকে মুক্তজীবন থেকে মুক্তি দিয়ে আটকে রাখতে চাইবো? ওই যে, স্বার্থমাখা মায়া! আমার স্বার্থমিশ্রিত মায়ার টানেই আমি যেতে চাইবো না। শেকলবন্দি হয়ে থাকবো আজীবন। কি বিচিত্র মানুষের মন!

আজ সকালে আমার এই খাঁচাবন্দি পাখিটির দুশ্চিন্তায় অসময়ে উঠে গেলাম। হুম, সকালটা আমার ঘুম ভাঙার পক্ষে অসময়ই বটে। রাতেও ঘুম হয়নি। অস্থিরতায় ছটফট করেছি সারারাত। কারণটা স্রেফ মায়ামাখানো স্বার্থপরতা। তাকে আজ দিনকয়েকের জন্যে মুক্ত করে দিচ্ছি। কিন্তু চাইছি না। আমি হয়ত আজীবন খাঁচাবন্দি থাকতে রাজি আছি, পাখিটি তা নয়। তার মুক্তজীবনে সে কারও বাধা মানবে না। আমিও দ্বিধান্বিত হয়ে যাই, স্বাধীনতার মাঝে আমি পরাধীনতার ছায়া ফেলবার এমন কে? তবুও অযাচিত অধিকার খাটাই। ভাবি, যেতে দেবো না। কোনোভাবেই না। অমন খুঁজে খুঁজে হঠাৎ পাওয়া পাখিটিকে এত সহজে যেতে দেবো? যদি সে হারিয়ে যায়? পথ ভুলে আর ফিরে না আসে? শঙ্কায় আকুল হয়ে থাকি।

তবুও, শেষমেষ কিছু করার থাকে না। কিছু পাখিকে সাময়িকভাবে পাওয়া যায়, খাঁচাবন্দি করে, মায়ার শেকলে বেঁধে খানিক আনন্দ পাওয়া যায়; তবু তাদের মন পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমরা কারও কারও জন্য কখনও সব সুখ উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত থাকি, তারা থাকে না, তারা চায় না, ভাবে, “একসময় সব বাঁধা ছেড়ে পালাবো, ওকে আমার ভালো লাগে না। যাকে ভালো লাগে না, তার জন্যে কেন সব সুখ উৎসর্গ করে দেবো? ও আমি পারবো না’।

একটা কবিতা থাকলো শেষে। হয়ত বুঝবে। তুমি কবিতা আমার থেকে অনেক ভালো বোঝো।

“হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷

তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে৷

নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়ে তো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷

তুই কেমন করে যাবি?

–   যাত্রা-ভঙ্গ/নির্মলেন্দু গুণ

প্রশ্ন রইলো শেষে।

শুভ হোক যাত্রা।

ইতি,

কাঠপুতুল

খামবন্দি অনুভূতি : প্রিয় কথা ও অন্যান্য


প্রিয় রোদ্দুর,

আজ মনে হচ্ছে ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি হলে বেশ হতো। ভাবছো, “ঝাঁপিয়ে বৃষ্টি”টা কেমন? সেটাকে তুমি আরও কিছু শব্দ দিয়ে বিশেষিত করতে পারো। ঝুম বৃষ্টি, অঝোর বৃষ্টি; এরচে ভালো কোনো বিশেষণ কি তুমি খুঁজে বের করতে পারবে? অভিধান ঘাঁটতে যেও না। বরং ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার কাছে এসে দাঁড়াও। হাতদুটোকে আড়াআড়ি ভাঁজ করে রাখতে পারো। চোখ বন্ধ করো। তারপর ভাবো, একটু একটু করে মৃদুলয়ে নুপূরের শব্দ শুনতে পাচ্ছো। ঝুম ঝুম ঝুম…ধীরে ধীরে শব্দটা বাড়ছে দেখো। প্রথমে থেমে থেমে, তারপর একটানা বেজেই চলেছে। মেঘকন্যা তার বন্দিজীবনের মুক্তির আনন্দে অবিরাম নেচে চলেছে। ধূসর-নীলচে আঁচল লুটোচ্ছে নরম তুলোর মত মেঘের গায়ে। আর তার পায়ের নুপূর একটু করে সিক্ত হচ্ছে। নুপূরের শব্দটা কি বেড়েছে অনেক? এবার তবে সে থামবে। তার পায়ের নুপূর চুইয়ে জল পড়ছে টুপটুপ। এবার চোখ খোলো।

আমি খুব ভালো বিবরণ দিতে পারিনি জানি। আমি আসলে কিছুই পারি না, কিছুই বুঝি না। আমি শুধু অনুভব করতে পারি। তাও বোধহয় তোমার মতো করে নয়। আমার দুর্বল বাক্যবিন্যাসে হয়ত তুমি শুধু অঝোরধারার বৃষ্টিই নয়, মেঘকন্যার নাচের সাথে খানিকটা ক্রোধের মিশ্রণ ঘটিয়ে কালবৈশাখী ঘটিয়ে ফেলেছো!

আমরা হয়ত জানতে উৎসুক থাকি, আমাদের প্রিয় মানুষগুলো আমাদের কাছে কতটুকু প্রিয়। এ ব্যাপারে আমার বিশেষ কোনো উত্তর নেই। আমার এক সহপাঠিনীর কথা মনে পড়লো। সে হয়ত খুব ভালো বন্ধু হয়ে উঠতে পারতো। কিন্তু বোধহয় আমিই তাকে সুযোগটা দিইনি। কেন দিইনি জানি না। আমার খুব কাছের একটামাত্র বন্ধু আছে, আর আমিও কেমন উন্মাদ, আমি তার সময়টুকু কারও সাথে ভাগ করে নিতে চাইনি। চেয়েছিলাম, তার জন্যে জমা রাখা সময়টুকু শুধু তার হাতেই দেবো। সেই জের ধরে সরানো মানুষগুলোর মধ্যে তাকেও ফেলে দিলাম। একদিন কথাপ্রসঙ্গে সেই সহপাঠিনীটি বলল, “তোমার সাথে আমার যতটুকু বন্ধুতা হয়েছে, তাতে তোমার কোনো অবদান নেই। সবটা আমার করা। এটা তুমি অস্বীকার করতে পারবে না। তুমি কেমন যেন মাঝে একটা দেয়াল তুলে রাখো সবসময়”।

প্রথমবার কেউ আমার একটা প্রকৃতি বুঝতে পারলো। আমি নিজেও জানতাম না। বুঝতাম না, কেন আমার খুব ভালো কোনো বন্ধু হয় না, কিংবা আমি কেন প্রাণখুলে কারও সাথে কথা বলতে পারি না, আর দশজনের মাঝে প্রাণখুলে হাসতে পারি না। এখন বুঝি। অদৃশ্য দেয়ালটাই কারণ। তবুও আমি চাই না, দেয়ালটা ভেঙে যাক। অন্তত একটা বন্ধু আছে, যে এই দেয়ালটাকে পেরিয়ে চলে এসেছিলো। যদি সত্যিকার অর্থেই সে পারে, তবে হয়ত আরও কেউ পারবে। বেশ ভালোভাবেই পারবে। আমার বন্ধুটি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়ে উঠেছে, হয়ত এই দেয়াল পেরিয়ে আসার জোরেই।

কি যেন বলতে বসেছিলাম। নানা কথার ফাঁদে হারিয়ে যাচ্ছি। আজকাল কেমন আনমনা হয়েছি দেখেছো? অন্যের কথা শুনতে কারোরই ভালো লাগে না জানি, কিন্তু চিঠি পড়তে হয়ত তোমার বেশ লাগে। তোমাদের ছাদে জবা ফুল আছে? আমার খুব দরকার। বায়োলজি প্র্যাকটিক্যালে কাটতে হবে। অদ্ভুত একটা ব্যাপার। ভেবে দেখো তো, এইচএসসি পরীক্ষার সময় শত শত গাছ থেকে টুপটুপ করে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে রক্তলাল জবা? আজকাল জবাফুলের নানা জাত দেখি। সেদিন দেখলাম কমলা রঙের জবা। আরেকজনের হাতে গোলাপি জবা। তবে রক্তলাল জবাই সম্ভবত সবচে সুন্দর, অতুলনীয়। ‘সম্ভবত’ শব্দটা ব্যবহার করলাম কেন ভাবছো? জবা আমার কখনই ভালো লাগেনি। জবা নামটাও ভালো লাগেনি। জবার পরিবর্তে তার যদি নাম রঙ্গন কিংবা কাঞ্চন কিংবা মল্লিকা কিংবা নিদেনপক্ষে শিউলি বা বকুল হত, তবে হয়ত জবাকে আমি একেবারে অগ্রাহ্য করতে পারতাম না। নামে কি এসে যায়, তাই কি বললে আপনমনে? বেশ, রহিমা কিংবা করিমা কারও নাম শুনলে যতটুকু ভালো বোধ হয়, তারচে বেশি কি অনিন্দিতা কিংবা সুপ্রভা নামটা শুনতে বেশি শ্রুতিমধুর লাগে না? হরিশঙ্কর জলদাসের রামগোলাম পড়ছিলাম, সেখানে মেথরসর্দার গুরুচরণের পৌত্রের নাম তিনি রামগোলাম রেখেছিলেন যাতে করে হিন্দু-মুসলিম উভয়ের কাছে সে সম্মান পায়। রামায়ণের রাম থেকে রাম, আর গোলাম হচ্ছে ইসলাম ধর্ম থেকে। লাভ হয়নি। রামগোলাম ছন্নছাড়া হয়েই শেষমেষ ঘুরে বেরিয়েছিলো। মানুষের অদৃষ্ট কি অদ্ভুত, না? যতই আমরা বলি, ভাগ্য বলে কিছু নেই, কিন্তু সেই ভাগ্যের ফেরেই আমরা নিতান্ত অসহায় হয়ে পড়ি। হয়ত কর্মফল।

কর্মফল নিয়ে প্রথম আমাকে একটা ছবি দিয়েছিলো ফেসবুকের এক বন্ধু। কূপজলের অনুভূতিহীন মানুষ। আমাকে বলেছিলেন, “কর্মফলে বিশ্বাস করো?” আমি বোধহয় বলেছিলাম, “জিনিসটা ঠিক বুঝি না’। ছবিটার মর্মার্থ ছিল, মানুষ যা করে, তার দশগুণ (নাকি দ্বিগুণ?) ফিরে পায়। খানিকটা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি জিনিসটা। পৃথিবী কত বিচিত্র, না? কত রকম বিশ্বাস মানুষের…

কি যেন লিখতে বসেছিলাম তাই ভুলে গেছি। বড় অন্যমনস্ক থাকি। এখন হয়ত প্রায়শই চিঠি পাঠানো হবে তোমাকে। আকাশের ঠিকানায় পাঠাবো না। আমি তো যক্ষের প্রেমিকা নই, যে, দূরদেশে যক্ষের কাছে চিঠি পাঠাতে মেঘকে বর্ণনা দেবো সেই দেশের! তোমার ঠিকানা জানা আছে, সোজাসুজি সেখানেই পাঠাবো। শুধু শুধু লিখবার জন্যে তো লেখা নয়, তোমাকে জোর করে পড়ানোর জন্যে লেখা। অবশ্য তোমার উত্তর আসেনা কখনই। আসবার কথাও নয়। তুমি চিঠি লিখতে জানো না।

আপাতত আর পারছি না। তীব্র মাথাব্যথায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। তবুও থামা যাচ্ছে না। জীবন প্রবহমান। জীবনটা এত বেশি গতিশীল আজকাল, একটু থেমে গেলেই বন্ধ ঘড়ির মত অচল হয়ে যাবার শঙ্কা পেয়ে বসে। আমার আশেপাশে আর কেউ নেই যে আমাকে আবার ঠেলে সচল করে দেবে। এমন জীবনের কী মানে?

“আচমকা স্রোতের পাশে হেলে পড়া কম বৃক্ষটি
এরও কোনো মানে আছে।

নির্জন মাঠের পোড়োবাড়ি- হা হা করে ভাঙা পাল্লা
এরও কোনো মানে আছে?

চেনা বানানের ভূল বারবার। অকস্মাৎ স্মৃতির অতল
থেকে উঠে আসে গানের দু’একটা লাইন
বারান্দায় পাখিটি বসেই উড়ে যায়
হেমকান্তি সন্ধ্যার আড়ালে
এর কোনো মানে নেই?”

–   মানে আছে/ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়।

আজকাল কবিতা পড়ি, সময় পেলে। হয়ত সবটা বুঝি না, কিন্তু বুঝতে চাই, ব্যাকুলভাবে বুঝতে চাই!

ভালো থেকো।

ইতি,

কাঠপুতুল

খামবন্দি অনুভূতি : হাসিকান্নার গল্প


প্রিয় রোদ্দুর,

মাঝেমধ্যে কী এমন হয় না, ভীষণ বিষাদে হৃদয় কেমন যেন নুইয়ে পড়ে? অদ্ভুত একটা কথা, বুঝতে পারছি, এর মাঝেই নাকমুখ বিকৃত করে উৎকট একটা মুখ করে ফেলেছো। পেছন ফিরে লাইনটা পড়ে নিজেই হেসে ফেললাম। আজকাল অকারণে হাসি। হাসি নিয়ে সবচে মজার ঘটনাটা হয়েছে দিনদুয়েক আগে। কি কারণে এক বন্ধুকে ফোন করে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে কেঁদে ফেললাম। এই আর এক জ্বালা! কান্না শুরু করলে থামানোটা মুশকিল হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুটি বলল, “কাঁদতে কাঁদতে বন্যা ভাসায় দেবে নাকি?” একটু থেমে চোখ মুছে বললাম, “বন্যা হয় নাকি কাঁদতে কাঁদতে?” বলল, “এই যে, ফোনের এই পাশে পানি চলে এলো যে! ফোঁটা ফোঁটা…” শুনেই হাসিতে ফেটে পড়লাম। বললাম, “এই ব্যবস্থা থাকলে তো বেশ হতো। ধরো, কারও উপর খুব রাগ। ফোন দিয়ে এপাশ থেকে পানি ঢালা শুরু করবো, সব পানি কানের এ পাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে যাবে!” হাসি থামানোটা কষ্টকর হয়ে গেছিল সেদিন।

আপাতত তেমন কোনো হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে জানো বোধহয় হাসির জন্যে আমার তেমন কোনো কারণ লাগে না। এ মুহূর্তে সেরকম কারণও খুঁজে পাচ্ছি না, যাতে প্রাণখুলে হাসা যাবে। হুমম, ফেসবুক খোলা আছে। বিভিন্ন মজার পেজের ছবিগুলো দেখে সাময়িক একটা হাসি খেলে যায়, তবে সেটা স্থায়ী নয়। নিজের মাথায় কোনো উদ্ভট জিনিস কল্পনা করে হাসতে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। যেমন ধরো, আম্মুর সামিলকে ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করানো কিংবা রাস্তার ধারে গাছের নিচে চায়ের কাপ হাতে বসা কারো চায়ে উপর থেকে টুপ করে কিছু একটা এসে পড়া…; থাক, রাত দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি, এখন একা একা হাসলে স্থায়ীভাবে মানসিক হাসপাতালে ব্যাগ গুছিয়ে থিতু হতে হবে হয়ত!

সেটা হয়ত খারাপ হত না। বাসায় থাকতে থাকতে আমার অবস্থা হয়েছে ছোটবেলার সেই কলমের ম্যাজিকটার মত। দুটো কলমকে আড়াআড়ি কিছুক্ষণ একেবারে স্থির করে ধরে রাখলে তারপরে সেটাকে ওঠাতে গেলে একটু বাধা পেতে হয়। কেমন যেন চুম্বকের মতো টেনে রাখে কলমদুটো। আমার অবস্থা হয়েছে কলমদুটোর মতো। এখন আর একদমই বেরোতে ইচ্ছে করে না। স্বেচ্ছানির্বাসনে আছি। নিজেকে নিজের জগতেই নির্বাসন দিয়েছি। ভালোই লাগে। ভালো লাগতোও একসময়। তবে মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। পালাতে ইচ্ছে করে। একা একা পালাবোও বা কোথায়? বড়জোর এই শহরের অলিগলি পর্যন্তই হারাতে পারবো। আমার সাদা-নীলাভ আকাশ কিংবা সবুজ সিক্ত শিশিরের স্পর্শ এই ইট-কাঠের শহরে আমি কোথায় পাবো? পালিয়ে তো উদ্দেশ্য সাধন হবে না। লাভ কী?

তাই ইচ্ছেটাকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ঘুমাক, যখন আমার অঢেল সময় হবে, যখন আমার কাছে কারও কিছু চাইবার থাকবে না কিংবা যখন নিজের কাছে নিজেরই কিছু চাইবার থাকবে না, তখন ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে দেবো। সাবধানে তার গায়ে সূর্যরশ্মি ছুইঁয়ে বলবো, “রাজকন্যা, তোমার ঘুম ভাঙবার সময় হলো”। তারপর…

তারপর নিঃসীমভাবে ছুটে বেড়ানো। ভাবছো, ছুটতে কেন হবে? কিংবা কেন ধীর পায়ে হাঁটবো না? আহ, এত খুঁটিয়ে প্রশ্ন কোরো না। সবুজ ঘাস কিংবা নরম মাটির দেখা পেলে তাতে ধীর পায়েই হাঁটবো। ঘাসফুলগুলোকে এড়িয়ে, তাদের বড় কষ্ট হয় জানো? হুমম, তোমার জানার কথা নয়। কেমন করেই বা জানবে? কখনও কি দেখেছো, তোমার পাশে, তোমারই মতো একজন মৃতবৎ নুইয়ে পড়ে আছে? আমি দেখেছিলাম। সে কথা আরেকদিন হবে। আপাতত একটু স্বার্থপর হই।

বোধহয় খানিকটা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছো। বিষাদে কিভাবে হৃদয় নুইয়ে পড়ে, তা জানতে। একেকজনের কাছে হয়ত এর ব্যাখ্যাটা একেকরকম হবে। আমার কাছে বিষাদে নুইয়ে পড়া মানে প্রবল বিষাদে অসীম নৈঃশব্দ্যের মাঝে ডুবে যাওয়া। সামনের ফেব্রুয়ারিতে আঠারোয় পা দিচ্ছি, তবে সেটা পৃথিবীতে আমার বিচরণকাল মাত্র। মনের দিক থেকে আমি আঠারোর ধারে কাছেও বোধহয় পৌঁছোইনি। এখনও অনেক কিছু বুঝি না, জানি না, চিনি না। তবে পার্থিবভাবেই টিনেজটাইমটা পেরিয়ে যাচ্ছি। টিনেজটাইমের কোনো শ্রুতিমধুর বাংলা জানলে জানিও। এটার আভিধানিক বাংলাটা আমার ভালো লাগে না। যা বলছিলাম, আগে বোধহয় দেখেছো, রেগে গেলে কিংবা বিষণ্ণ হলে কোনো না কোনোভাবে সেটাকে বের করে দিতাম। কে যেন বলেছিল, রাগী মানুষদের হৃদয় পরিচ্ছন্ন থাকে। হয়ত নিজের হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন রাখতে চাইতাম বলেই সেই ক্রোধটাকে বের করে দিতাম। এখন আর দিই না। এখন নীলাকাশে ভাসিয়ে দিই। আকাশের হৃদয়টা কত বড় দেখেছো? কতকিছু সে দেখে, কতকিছুকে সে টেনে নেয়, কতকিছুকে সে সহ্য করে নেয়। আমাদের হৃদয় আকাশের মত এমন বড় হয় না কেন? মাটির পৃথিবীতে থেকে আমাদের হৃদয়টা এমন কর্দমাক্ত, ধুলোমাখা হয়ে যায় কেন?

বারবার এ কথা থেকে সে কথায় চলে যাচ্ছি। আজ বড় বিক্ষিপ্ত লাগছে। অথচ এখন আমার থাকা দরকার শীতের সমুদ্রের মত শান্ত, ঢেউহীন। অথচ আজই যেন ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রচণ্ডবেগে সবকিছুকে ধ্বংস করে দিতে চাইছি। এটা বোধহয় ঠিক ধ্বংস করবার ইচ্ছেও নয়। কী হতে পারে? আগ্নেয়গিরি? উপমাটা খানিকটা হাস্যকর। তবে বোধহয় এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত উপমা। জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ সিনেমাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। শেষদিকে এরকম একটা দৃশ্য ছিল। একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির আশেপাশে সবুজের সমারোহ, হঠাৎ করে ভেতর থেকে পাথর বেরিয়ে আসতে শুরু করলো প্রবল বেগে। এরকম কিছু একটা। মনে পড়ছে না।

যা বলছিলাম, আঠারো। এখন কেন যেন আর সেভাবে রাগটাকে প্রকাশ করি না। রাগ হলেও নিজেই নিজেকে শান্ত করি। কেন যেন সর্বক্ষণ একটা অসহায় অনুভূতি হতে থাকে। মনে হয়, খুব অল্প সময় হাতে আছে, সেটুকু যদি রাগের মত অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ব্যয় করি, তাতে কোনো সুখ নেই। আজকাল আর আগের মত মন খারাপও করি না। তার অবশ্য কারণ আছে। সময় কোথায়? প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি আজকাল। মনখারাপের ক্ষেত্রেও হয়ত সেই অল্প সময়ের তাড়নাটা কাজ করে। হেসে ফেলি, শান্ত থাকি, স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করি।

আজ আর লিখছি না। বিশাল লম্বা চিঠি হয়ে গেলো। একটা বাক্য দিয়ে কতকিছু লিখে ফেললাম দেখেছো? তবুও যেন অনেক কিছু বলা হলো না। ঠিক যেমন সুনীলের মত। কত কাজ বাকি রেখে চলে গেলেন। তার প্রথম আলো বইটা পড়া শেষ করিনি এখনও। তবে ভীষণ ভালো লাগছে পড়তে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ভূমিসূতাকে কেন্দ্র করে চরিত্রগুলোর আবর্তন, আর হ্যা, কাদম্বরীর চরিত্রাঙ্কন। পড়াশোনা সামলে নিয়ে আশা করি বাকি লেখাগুলোও পড়ে নিতে পারবো। এর মাঝে সত্যজিতের ছোটগল্পগুলো পড়া হয়েছে। ।“বর্ণান্ধ” গল্পটার কথা প্রায়শ মনে পড়ে।

“কী ভাবছো তুমি? ভাবছ আমি দুর্বল! ভাবছ যে, ভাগ্যের চাকার তলায় সেইজন্যেই আমি গুঁড়িয়ে গেছি! নিজের কথা বলতে পারি, আমি যে আত্মহত্যা করিনি কেন, এই কথা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাই। কারণটা হয়ত এই যে, বাঁচতে আমার ভারী ভালো লাগে, আর নয়ত আমি ভীতু, কাপুরুষ। হয়তো সেটাই সত্যি কথা। নইলে দ্যাখো আজ আমার কাছে জীবনের কী অর্থ? শিল্পের কী অর্থ? যে লোক ধূসর ছাড়া…হরেক রকমের একঘেয়ে ধূসর ছাড়া কোনও রঙই দেখতে পায় না, সেজন্যে মাতিস আর রেনোয়ার ছবিরই বা তার কাছে কী অর্থ?”

ভালো থেকো।

-কাঠপুতুল

কনফেশান-১


ভাবছি লেখাটার নাম দেবো কনফেশান। এটার বাংলা কোনো প্রতিশব্দ জানা আছে? হুম, স্বীকারোক্তি। তবে এরচে যেন কনফেশান শব্দটাই বেশি ভালো লাগছে। না?

লেখাটার আসলে কোনো অর্থ নেই। আমার কোনো লেখারই অর্থ থাকে না। আমার কোনো কাজেরও ইদানিং কোনো অর্থ নেই। উন্মাদ হয়ে গেছি আজকাল। এলোমেলো, অগোছালো, একটু কঠিন শব্দ ব্যবহার করলে ছন্নছাড়া বলা যেতে পারে। চরিত্রের সব কঠিন দিকগুলো একেবারে তুঙ্গে উঠে বসে আছে। প্রচণ্ড রকম স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছি। প্রচণ্ড জেদী ছিলাম আগে থেকেই, মাঝে কিছু কমিয়ে এনেছিলাম। তবে তার জায়গায় এসে গুছিয়ে বসেছিলো অভিমান। এখন একসাথে জেদ-অভিমান সব দৌড়োতে শুরু করেছে। দু’শ মিটার রেস যেন, স্বর্ণপদকটা পেতেই হবে…

ইদানিং খুব হিসেব করে চলি। সময়কে অসংখ্যবার হিসেবের খাতা-কলমে বাঁধা ফেলতে চেয়েছি। পারিনি। সবশেষে বুঝেছি, আমার সময় চলে আমার প্রতিমুহূর্তের মানুষগুলোকে  কেন্দ্র করে। আমার উন্মাদভাব (উন্মাদ’র বিশেষ্য কী? উন্মাদনা?) ইদানিং বেড়েছে প্রচণ্ড মাত্রায়। যখন তখন সব ছুঁড়ে ফেলে ঘুমিয়ে পড়ি, যখন তখন সব ছুঁড়ে ফেলে Poets of the fall এর কাছে আশ্রয় নিই, ঘর আঁধার করে তাদের সুরে হারিয়ে যেতে যেতে টুপ করে ঘুম…তারপরে স্বপ্নে বিচরণ।

কাল রাতে হঠাৎ দাদুমণিকে স্বপ্নে দেখলাম। তার সাথে আমার অভিজ্ঞতা বরাবরই খুব তিক্ত। যা হোক, স্বপ্নে দেখলাম, উনি (দ্বিতীয়বার?) মৃত্যুশয্যায়। আমরা সবাই চারপাশে দাঁড়িয়ে। আমি কিছুটা বেশি দূরত্ব রেখে দাঁড়িয়ে। উনি হাত নেড়ে ডাকলেন। ভীত পায়ে এগিয়ে গেলাম ছোট্ট আমি। উনি দুহাতে আমার মুখ আঁকড়ে ধরে স্মিত হেসে আশীর্বাদসূচক কিছু বললেন। এরপরেই আচমকা ঘুম ভেঙে গেল।

তাকে দেখার দিন আমি আরও বেশি উন্মাদ হয়ে যাই। প্রচণ্ড অস্থিরতায় সব তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করে। একরকম বিষাদ, একরকম অযৌক্তিক ঘৃণাবোধে আমি ক’টা দিন নুয়ে থাকি।

আজকাল আর প্রিয় মানুষগুলোকে স্বপ্নে দেখি না। প্রিয় শব্দটা খুব আপেক্ষিক। অন্তত আমার জন্যে। আজ যে প্রিয়, কাল হয়ত কোনো তুচ্ছ কারণে আঘাত পেয়ে, আকাশছোয়া অভিমানে তাকে ছুঁড়ে দিতে দ্বিধাবোধ করব না। স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সীমা নেই আজকাল। প্রায় সব প্রিয় মানুষকে প্রচণ্ড অভিমানে সরিয়ে দিয়েছি দিন কয়েক আগে। আমি তাদের বুঝি না, তারা আমাকে বোঝে না। অবশ্য অস্থিরমতি ছটফটে আমাকে কারোরই বোঝার কথা নয়। আমার এই স্বেচ্ছাচারিতা-জেদ-অভিমানের কাঁটায় আর কাউকে বিঁধতে ইচ্ছে করে না। পুরোপুরি নিজের মত থাকতে চাই। সবশেষে আবার সেই এক কোণেতেই আমার আবাস…

আজকাল আর ঘর থেকে বেরোতেও ইচ্ছে করে না। আগে অস্থির হয়ে থাকতাম, কখন বেরোবো, কোথায় যাবো। এখন আর ইচ্ছে করে না। মাসে অন্তত তিনবার ডাক্তারের মুখদর্শন করতে হবে, সেটাও যেতে ইচ্ছে করে না। শুধু কলেজে যাই, তারপরে ঘর। শুয়ে, বসে, বুকশেলফের ডেস্কে পা ঝুলিয়ে, কিন্তু ড্রেসিং টেবিলের টেবিলটপে পা ঝুলিয়ে, পড়ার টেবিল, বইখাতায় ডুবে থাকা আমার চব্বিশ ঘণ্টায় ঘড়ির কাঁটা কতবার লাফঝাঁপ দিয়ে যায়, খেয়াল থাকে না।

থাক। আজকে আর লেখার মুড পাচ্ছি না। আসলে আমি লিখতেও জানি না। শেষে গানের দুটো লাইন দিই।

 “অজস্র দিন হেঁটে চলে যায়
জেগে থাকা রাত দুর্বিষহ
চুপ করে যাওয়া খামখেয়ালি
নিভে যায় সব তারা অহরহ…

তুই নেই তাই
তুই নেই তাই…”।

ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া সব মানুষেরা ভালো থাকুক।

চোখ


খুব মনোযোগ দিয়ে গোল্ডফিশগুলোকে লক্ষ করছিলাম। অদ্ভুত একটা গোল্ডফিশ বারবার নজর কেড়ে নিচ্ছিলো। মাছটার চোখের কোটরটা শূন্য। কিন্তু বেশ চমৎকারভাবে পাখনা নেড়ে নেড়ে স্বচ্ছ জলের মাঝ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে আরও অনেকগুলো ক্ষুধার্ত গোল্ডফিশ ভাসছে। ভাসছে একজোড়া কালো শার্কার। গোল্ডফিশটা জানে না, সে কতটা আকাঙ্ক্ষিত। তার মৃত্যু কতটা আকাঙ্ক্ষিত এই রোজ একঘেয়ে ছোট লাল দানার খাবার খাওয়া পোষা মাছগুলোর কাছে। সে জানে না, তার চারপাশে স্বচ্ছ জলের মাঝে একটা নোনা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে, মৃত্যুদূত তার নোনা সুবাস ছড়িয়ে তার পিছু পিছু ঘুরছে। আচমকা হয়ত গোল্ডফিশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপরে। তার নরম সোনালি শরীর একটু একটু করে একটা ঠুকরে ঠুকরে খাবে তারই এতদিনের বন্ধুরা, তার এই বন্দিজীবনের বন্ধুরা। দিন পেরোবে, রাত পেরোবে, ঘড়ির কাঁটাগুলো একটার পর একটা সংখ্যা পেরিয়ে যাবে। আমার এই অন্ধ বন্ধুটির শরীর ততক্ষণে চাপা পড়বে সাদাকালো মার্বেল পাথরের নিচে। শেষমেশ হয়ত একটা মাঝারি আকারের কাঁটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ভাসমান অবস্থায়। নাও পাওয়া যেতে পারে।

 

বন্ধুটির জায়গায় হয়ত আর একজোড়া নতুন গোল্ডফিশ নিয়ে আসা হবে। সূর্যাস্তের আবির রঙা তার ছোট্ট শরীরের মাপের আরেকটা গোল্ডফিশ। বছর তিনেক পরে নতুন গোল্ডফিশটা আমার মতই কিশোর হয়ে উঠবে। আমার মত প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে। তাকে আমি অন্ধ হতে দেবো না। সে দেখতে পাবে তার মুখোশপরা রূপবান বন্ধুদের। দেখতে পাবে তার মৃত্যু্র আকাঙ্ক্ষারত বন্ধুদের। তাদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলবে। আবার সময় পেরোবে, দিন পেরোবে, রাত পেরোবে, দেয়ালঘড়িটার কাঁটাগুলো ৩৬০ ডিগ্রী কোণ পরিভ্রমণ করতে করতে টেবিল ক্যালেন্ডারকে জানান দেবে তার বেশ পরিবর্তন করবার কথা। ততদিনের বন্ধুটি হয়ে উঠবে হান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যাণ্ডারসনের সেই কুচ্ছিত হাঁসের গল্পের হাঁসের মত। ছোট্ট এক রত্তি গোল্ডফিশ ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠবে রূপবান ঈর্ষণীয় একটা মাছ।

 

আহ! কবে আসবে সেদিন? ততদিন পর্যন্ত কি আমার এই অন্ধ বন্ধুটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না? তাকে এই মৃত্যুকামী বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে তাকে নতুন জীবন দেওয়া যায় না? নাইবা দেখতে পেল সে আমাকে। কিন্তু তার প্রতি তো আমার ভালোবাসার অন্ত নেই। আমার ধারণা তার অন্ধ জীবনকে সে বেশ পছন্দই করবে। আমরা দু’জন একসাথে সাঁতরে বেড়াবো আলোহীন এক জগতে। কি এসে যায়? আমার মাছবন্ধুটিও জানে না তার মুখোশপরা শত্রুদের পরিচয়, আমিও জানি না। কি অসম্ভব একটা মিল আমাদের মাঝে! আমাদের জীবন এমনিভাবেই ভাসমান। এক কাঁচবাক্সে, একই জলে, একই কৃত্রিম ভাসমান গাছের মাঝে আমাদের বসবাস…

 

“আম্মু, দেখো এ্যাঞ্জেলমাছটাকে সবগুলো মাছ ঘিরে ধরেছে! ঠোকরাচ্ছে!” “ওরকম একটু হয়ই সোনা। তুমি বরং একটু বাগানের দিকে যাও। নতুন গোলাপ চারাগুলো লাগানো হচ্ছে”।

 

আমি তবুও খুশি। ক্ষুধার্ত গোল্ডফিশগুলোর সাথে আমার চুক্তি হয়েছে। আমি মারা গেলে তারা আমার চোখদুটোকে উপড়ে তুলে আমার বন্ধুটির চোখে বসিয়ে দেবে। কি চমৎকার একটা চিন্তা! সমুদ্রে থাকতে মা বলত, আমি খুব বুদ্ধিমান একটা বাচ্চা। মা থাকলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন। মা বলতেন, বন্ধুদের জন্য সব উজাড় করে দিতে হয়। আমি আমার চোখ দিয়ে দিচ্ছি আমার বন্ধুটিকে। এখন সে একটা অপূর্ব গোল্ডফিশ হয়ে উঠতে পারবে। তার চোখ থেকে আমার চোখ দিয়ে কাঁচবাক্সের গায়ে বন্ধুটির নিত্য পরিবর্তন দেখতে পাবো। দেখতে পাবো আমাদের জলজ জীবনকে।

 

-“আম্মু, এটা কিভাবে হল?”

-“জানি না সোনা।“

-“কি বীভৎস! একুরিয়ামের একটা মাছেরও চোখ নেই! চোখহীন এতগুলো মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে!”

-“এই যে এই গোল্ডফিশটার এখনও চোখ আছে! এটাকে একটা জারে দিয়ে দাও সোনা।“

-“কিন্তু আম্মু, এটার চোখটা যেন কেমন! গোল্ডফিশের চোখ কি এমন থাকে?”

-“জানিনা সোনা”।

কাঠপুতুলের গল্প-৪ : আত্মকথোপকথন


-আজকাল ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছো। আগেকার সেই জেদ অভিমান অশ্রুবর্ষণ ক্রোধ কিছুই আর তেমনভাবে তোমাকে আক্রান্ত করে না দেখছি!

– হুম, কি প্রবল ক্রোধে সব তছনছ করে দিতাম কিছু না পেলে। ভালোবাসার খানিক অভাববোধ হলে সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নীরব অশ্রুবর্ষণের সেই প্রবণতাটা আজকাল হাস্যরসের যোগান দেয় আমার। কথায় ভালোবাসার অনুপস্থিতিবোধে সীমাহীন অভিমানে ধ্বংস করে দিতে চাইতাম সব…

-সেই তো ভালো। কাঠপুতুল কৈশোরের বন্ধ দরজা পেরিয়ে তারুণ্যের মুক্ত আকাশের দিকে এগোচ্ছে…বুঝতে শুরু করেছে, নিষ্প্রাণ-নিষ্ঠুর-স্বার্থপর এই পৃথিবীতে আমাদের কারোর জন্যেই কারো সময় নেই।

-একটা জিনিস এখনও বদলায়নি। বোধহয় বদলাবে না।

-জানি, সময় চেয়েও না পাওয়া।

-এই একটামাত্র অপার্থিবের কাছে নিয়তই আমি পরাজিত। কে জানে, একসময় হয়ত এমন দিন আসবে, যখন আমার কাছে কেউ সময় চেয়ে ব্যর্থ হবে।

-এতদিনকার অপ্রাপ্তির মধুর প্রতিশোধ হবে তখন, নয় কি?

-প্রতিশোধ নিয়ে লাভ? আমার ক্রোধের বিলুপ্তি ঘটছে ক্রমশ। প্রতিশোধ নিতে সীমাহীন ক্রোধের দরকার হয়। আজকাল সেই ক্রোধটা পরিমাপের আওতায় এসেছে। প্রতিশোধ বিদায় নিয়েছে অনেক আগেই…
-তোমার এই কোমলতা আর করুণাকে আমি ঘৃণা করি। *
-করতেই পারো। আমাকেই ঘৃণা করতে পারো। ঘৃণা করতে পারো আমার এই অবচেতনে বদলে যাওয়াকেও। বলতে পারো, নতুন এ পৃথিবীতে ক্রোধ-অভিমান-জেদের যত বিকাশ হবে, ততই উত্তম। কিন্তু, আমি যে বদলে যাচ্ছি আপনা থেকেই…
-বিধাতা যা ভালো বোঝেন! তিনি যদি চান, তাই হবে। কাঠপুতুল চোখের নিমিষে সবকিছু ধ্বংস করে দেবে অবলীলায়।-দেখা যাক, কী হয়। এখন হয়ত খানিক ভালোবাসার স্পর্শে নক্ষত্র খানিক উজ্জ্বল হয়ে জ্বলে উঠেছে। হয়ত শতবর্ষ পরে সেই আবেগটুকুই নক্ষত্রকে বিস্ফোরিত করে দেবে! কে বলতে পারে, সেসব অনুভূতির বিলুপ্তি ঘটেছে; হতে পারে, সেসব জমা হচ্ছে ধীরে ধীরে, উপযুক্ত মুহূর্তের অপেক্ষায়, সবকিছু ধ্বংস করে দেবার জন্যে…

-সেদিন কাঠপুতুল আপন রূপে আবির্ভূত হবে। এই কোমলতা তোমার শোভা পায় না কাঠপুতুল।

-অনেকটা সময় বাকি এখনও। আঁধার নামছে দেখো…

-হৃদয়ে?

-হৃদয় তো সবসময়ে সবারই আঁধার। তাতে আলো দেবার মানুষ কই? আমরা উন্মত্ত কত দ্রুত একে অপরের হৃদয়ে অমাবস্যার আঁধার নামিয়ে দিতে পারি, কত ক্ষিপ্রতায় হৃদয়ের কোমলতাকে চূর্ণ করে দিতে পারি, নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থপরতার বীজ বুনে দিতে পারি…

-কেন বুনি বলতে পারো?

-সে তো জানা নেই। সেই সর্বগ্রাসী বৃক্ষের কোনো ছায়াও নেই যে তার নিচে ক্লান্ত পথিক জিরিয়ে নিতে পারে…

-নাহ, উপড়ে যাওয়া বিশালাকার শেকড়ের গাছ দেখেছো? শুধু শেকড়টুকু উপড়ে আসে না, যে মৃত্তিকার বুকে তার এতদিনকার নির্ভার আশ্রয়, তাকেও সে উপড়ে তুলে আনে। এমনিভাবে যখন তুমি প্রবল ক্রোধে সবকিছু ধ্বংস করে দিতে উদ্যত হবে, সেই বৃক্ষগুলো তার এতদিনকার আশ্রয়টুকু, পচে যাওয়া হৃদয়টুকুকেও তুলে আনবে তার শেকড়ের সাথে। ভাবতে পারো, তার নিচে শুদ্ধতম একেকটা হৃদয় শায়িত থাকবে। ভালোবাসা-স্নেহ-আন্তরিকতায় সিক্ত একেকটা হৃদয়…

-সেই হৃদয়ে কি করুণা থাকবে? আমার জন্যে একটুখানি সময় দেবার মত করুণা?

-নিশ্চয়ই কাঠপুতুল। একদিন না একদিন অমন একটা হৃদয়ের আবির্ভাব হবে নিশ্চয়ই…।

*কথাটা ফাতেমা আবেদীন নাজলা আপুর। আমার খুব ভালো লাগে।