প্রিয় রোদ্দুর,
মন বোধহয় মাঝেমধ্যে মানুষের অজান্তেই আপন অনুভূতিগুলোকে উৎসারিত করে দেয়। মানুষটিকে না জানিয়েই। যেমন আমি এই মাঝরাত্তিরে গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম, “হারাই হারাই সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে…”। মন যে জানে, আমি যে হারাবার ভীষণ ভয়ে আছি!
সচরাচর আমি বিধাতামুখী নই। স্বার্থবাদী। বিশ্বাস করি না তা নয়। করি। কিন্তু নেহাৎ দায়ে পড়লেই বিধাতার মুখাপেক্ষী হই। এ নিয়ে নিজেকে যে মাঝেমধ্যে দোষ দিই না, নিজেকে ধিক্কার দিই না, তাও নয়। দিই। ভালোভাবেই দিই। কিন্তু এই যে মন, কিছুতেই মানতে চায় না। নিজেকে স্বর্গমর্ত্যের অধীশ্বর ভাবতে ভালোবাসে। তবুও মাঝেমধ্যে সেও পরাভূত। কিছু না পাবার সম্ভাবনা থাকলে অনায়াসেই নির্লজ্জের মত নেমে আসে ধূলির পৃথিবীতে। মাথা নত করে বিধাতার কাছে। আজও করবে। বোধহয় করতে শুরু করবে চিরদিনের মত।
মনকে কিছুতেই সুস্থির করা যাচ্ছে না। একবার সে ভাবছে, প্রচণ্ড খেটেখুটে ভালো কোথাও এ্যাডমিশন নেবে; কখনও ভাবছে, আর সবার মতই এক্সামের পরেই খাটাখাটনি শুরু করবে; কখনও ভাবছে, ‘ধীরে এগোও বৎস’। সব মিলিয়ে কিছু না করবার সেই পুরনো অবস্থাতেই আছি।
আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসসমগ্র পড়বার সময় বের করতে পেরেছি অবশ্য। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তো কাটাই বিছানায়। আধো ঘুমে কিংবা নিদ্রাদেবীর উষ্ণ আমন্ত্রণে তার রাজ্যে। হয়ত বইটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। একটা লাইন বেশ ভালো লাগল,
“-সোজা কথা হচ্ছে, সমাজের মুখ চাইতে হবে, আইনের দায় মানতে হবে।
-তা বটে! শুধু চাইতে হবে না মানুষের মুখ, মানতে হবে না হৃদয় সত্যের দায়!”
আরও পড়ো,
“শুধু বুঝতে পারত না, হৃদয় সত্যের দায় পোহানোর ঝক্কি কতখানি। বুঝতে পারত না, সবাইয়ের সাধ্য নেই সেই ঝক্কি সামলাবার। সাধ্য নেই, তাই মানুষ সত্য আর মিথ্যা, খাঁটি আর ভেজাল, হৃদয়-দ্বন্দ্ব আর সমাজ দ্বন্দ্ব সবকিছুকে লোকচক্ষু নামক পাকযন্ত্রে চড়িয়ে একটা পাঁচন তৈরি করে করে গিলে জীবন-জ্বরের শান্তি খোঁজে”।
‘জহুরী’ উপন্যাস থেকে তুলে দিলাম লাইনগুলো। বেশ, না? অকাট্য সত্য। আমি কতবার কেবল সমাজের চোখে হেয় হবো ভেবে কত হৃদয়-সত্যকে ছাইচাপা দিয়ে এগিয়ে গেছি সামনের পথে, তার হিসেব নেই। সেদিন একজন আমাকে বলল, আমি মানুষের কথায় খুব বেশি কান দিই। খুব বেশি মূল্য দিই। সত্য। অস্বীকার করবার কিছু নেই। আমি নেহাৎই দুর্বল, ভীত এক বালিকা। যে কি না, অনায়াসে চাপা দিতে পারি হৃদয়-সত্য; মুখে হাসি আর হৃদয়ে ছাইচাপা বাসনার অবশেষ নিয়ে হেঁটে যেতে পারি বহুদূর, বহুদূর। কেবলই লোকচক্ষুর ভয়ে।
কে জানে! কে জানে!
তবে বিধাতামুখী হচ্ছি, এটা নিশ্চিত। আমার যে আজকাল খুব ভয় করে। ভবিষ্যত নিয়ে ভীষণ ভয় করে। মানুষজনের আশা-আকাঙ্ক্ষায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা বলতে কিছুই নেই। খুব সহজে আহত হই বলে তর্কও চালিয়ে যেতে পারি না। অপরপাশের মানুষটি মনে করে মেনে নিচ্ছি। সবশেষে তো মেনেই নিই।
ভেবেছিলাম জীবনে কখনও মেডিকেল প্রফেশনের দিকে যাবো না। কখনও আগ্রহ বোধ করিনি। শৈশবে ভাবতাম শিক্ষক হবো। বাবাও বলতেন, ভালো। দ্বিমত করতেন না। সময় পেরোবার সাথে সাথে জানলাম, তার আমাকে মেডিকেলে পড়াবার খুব শখ। বাবার সাথে প্রায় সংঘর্ষ বাঁধবার উপক্রম। তা অবশ্য প্রায় সময়েই বাঁধে। সেসব নিয়ে তেমন ভাবিতও হই না, যদিও প্রথমে ভেঙে পড়ি খুব। অথচ এখন দ্যাখো, ভাবছি কি না বুয়েটের আশা ছেড়ে মেডিকেলেই ঢুকবো। এ্যাডমিশনের প্রসেসটাও সহজ, বুয়েটের চেয়ে। আমি অতটা মেধাবীও নই কি না। এরচে সাফল্যের সংক্ষিপ্ততম পথটুকুই ধরা যাক। দুর্নামও হবে না। ভবিষ্যতটুকুও মসৃণ।
দেখেছো, এখানেও কিন্তু আমি সমাজের কথাই ভাবছি। লোকচক্ষুর কথাই ভাবছি। দুর্বল, দুর্বল এবং দুর্বল।
একবার এমনই এক দিনে, বসন্তের শুরুতে পরী বলেছিল, যা মন চায়, করে ফেলবি। থেমে থাকবি না। জীবনের আনন্দটুকু পাবি না তাহলে। সময় পেরোবার সাথে সাথে সেও বাবার মত বলে বসলো, আমাকে তার ডাক্তার হিসেবেই পছন্দ। বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম, বাকিরাও তাই ভাবছে। সহপাঠিনীরাও। ক্ষুব্ধ হলাম। বিষণ্ণ হলাম। কারোরই মন টললো না। কেউই ভেবে দেখলো না যে আমার তো সৃষ্টির নেশা। আমার কি ভালো লাগে, কেউই তলিয়ে দেখতে যাচ্ছে না। সময়ও খুব বেশি বাকি নেই। কেউ ভেবেও দেখবে না।
রোদ্দুর, শেষমেষ কি জীবনটা আমার থাকছে? নাকি স্রেফ অন্যদের জন্যে জীবনটাকে টুকরো টুকরো করে বিলিয়ে দিচ্ছি? যে এসে হাত পাতছে, অনায়াসে তাকে দিয়ে দিচ্ছি জীবনের একটুকরো। কোনো বাছাই ছাড়াই। উপযুক্ত-অনুপযুক্ততার কথাও ভাবছি না। স্রেফ, দিয়ে দিচ্ছি। কেন? লোকচক্ষুতে ভালো হবার জন্যে।
হ্যা, এ আমার সরল স্বীকারোক্তি। জীবনে প্রত্যেকটা কাজ করবার আগে শতবার ভেবে নিয়েছি, সমাজ কী বলবে। বাবা-মার লক্ষী মেয়েটি হয়ে থাকতে চেয়েছি। জীবনটাকে নিখুঁত রাখতে চেয়েছি প্রায়। রেজাল্ট খারাপ হলেও মা বলত আগে, ‘এখন ভেবে দ্যাখো, মানুষ কী ভাবছে?’ সেখানেও মানুষ। তথা সমাজ। এখন অবশ্য মা’র বলার ধরণটা বদলেছে। তাও তো প্রায় দশ বছর পেরিয়ে। নিজ থেকে বদলায়নি। বিধাতার ইশারাতেই বদলেছে।
রোদ্দুর, আমার যে খুব পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে। যেখানে গিয়ে বুঝতে পারব জীবন কাকে বলে। জীবনে অপ্রাপ্তি কাকে বলে। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা কাকে বলে। আমার এত নিখুঁত জীবনের যে প্রয়োজন নেই। স্রেফ নিজের ইচ্ছেমত বেঁচে থাকাটুকু শিখতে চাই। বিদ্রোহ করা শিখতে চাই। শিখতে চাই কিভাবে ‘না’ বলতে হয়।
ঘুরে ফিরে আবারও ডিসেম্বর। আর ২২ দিন বাকি, আমার পুনর্জন্মবার্ষিকীর। হাসি পাচ্ছে পড়তে, তাই না? সেভাবে করে পালন করবার কিছু নেই। পালন করতে পারতাম, যদি ফিরে এসে বুঝতে পারতাম জীবনের মর্মার্থ। যদি বুঝতে পারতাম, আমার নিজের মত করে, নিজের ইচ্ছেগুলোর উপর ভর করে বেঁচে থাকবার ইশারা আবার এই ফিরে আসা। কিচ্ছু বদলে যায়নি। নতুন করে বেঁচে উঠেও আমি স্রেফ লোকচক্ষুর ভয়েই নত আছি, নত আছি অন্যের আকাঙ্ক্ষা পূরণে। সেসময়কার কিছু চিঠিপত্র হাতে পেয়েছি পরী মারফত। একটা চিঠির এক জায়গায় লেখা, আমার মৃত্যুসংবাদ কোনো একজনকে বিচলিত করবার পরিবর্তে বিরক্ত করেছে।
বলা বাহুল্য, আমি যেন নিজের ভবিষ্যতটুকু দেখতে পেলাম সে বাক্যবিন্যাসে। সত্যিই, সবকিছু বিলিয়ে দিয়েও কি আমি কারো অনুভবের যোগ্য হতে পেরেছি? কিংবা পারব? প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কতখানি বিলিয়ে দিয়েছি। উত্তরে এটুকুই বলতে পারি, নিজের হাতে রাখিনি কিছুই। স্বাধীনতাটুকুও নয়। সবকিছুই অন্যের হাতে। তাও সেই ‘অন্য’ কোনো একজন নয়। একাধিক। ফলস্বরূপ, গ্রহীতার দৃষ্টিতে আমি কিছুই দিতে পারি নি। আর আমার দৃষ্টিতে, বিলিয়েছি সর্বস্ব।
আজ এটুকুই থাক। চিঠিটা দীর্ঘ হলেও মন শান্ত হয়েছে বোধ করি। বিধাতামুখী হবার সময় হয়ে এলো।
ইতি,
কাঠপুতুল