মেয়েটা..


চোখে চশমা লাগিয়ে কাগজের ওপর খসখস শব্দে লিখে যাচ্ছি। বাইরে তখন ঝুম বৃষ্টি। কিছু খেয়াল নেই। হঠা গুড়গুড় শব্দে কোথায় যেন বাজ পড়লো। অবাক ব্যাপার,আমি চমকে উঠলাম না। যেমন লিখছিলাম শুধু হাতের কলমটা থমকে গেল। ক্লান্ত একটা নিশ্বাস ফেলে কলমটা হাত থেকে সরালাম। ৩ ঘণ্টা ধরে নাকের ওপর চেপে বসা চশমাটা খুলে ধীরে ধীরে উঠে দাড়ালাম। জানালাটা বন্ধ ছিল । ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে। তবুও হাত বাড়িয়ে খুলে দিলাম। এক পশলা বৃষ্টি এসে আমায় ভিজিয়ে দিয়ে গেল। আহ! কতদিন এমন বৃষ্টি ছুঁই না। কিংবা আরো সহজ করে বললে বৃষ্টি আমায় ছোঁয় না। বাঁধা চুলগুলো খুলে দিলাম। মিষ্টি একটা ভেজা মাটির ঘ্রাণ আসছে বাইরে থেকে। ঘরের ঝলমলে আলো নিভিয়ে দাঁড়ালাম আবার জানালার পাশে। 

চোখ বন্ধ করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম কে জানে। আবার কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো। কেউ যেন আমায় ভেতর থেকে বললো,”এই মেয়ে, চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছিস যে, বাইরে তাকা!” ভেতরের এই মানুষটা আমায় বড্ড জ্বালায়, তবুও কিছু বলি না। এই তো একজন যে আমায় খুব ভালোভাবে বোঝে, আমার কথাগুলো শোনে, আমায় বড্ড ভালোবাসে। 

আনমনে এগুলো ভাবতে ভাবতেই আরো জোরে বৃষ্টি নামলো। ভাবছিলাম জানালাটা আটকে দেবো। হঠা চারদিক আলো এক চিলতে বিদ্যু চমকে উঠলো। ব্যস, সাথে সাথে লোডশেডিং। কি ভেবে আর মোমবাতি জ্বালালাম না। জানালার পাশে দাড়িয়ে বাইরে সিক্ত প্রকৃতি দেখছিলাম। 

হঠা আবছা একটা ছায়া দেখতে পেলাম যেন। একটা মেয়ে, সাদা রংয়ের একটা পোশাক পরা। খুব ধীরে ধীরে হাঁটছে। আমি অবাক চোখে তাকিয়ে আছি। মেয়েটার কি মাথা খারাপ! এই ঝুম বৃষ্টিতে বাইরে বেরিয়েছে! ক্ষণে ক্ষণে বাজ পড়ছে, হঠা যদি কিছু একটা…। আর ভাবতে পারলাম না। দরজা খুলে বাইরে বেরোলাম, হাতে একটা ছাতা নিয়ে। 

বৃষ্টিটা আরো বাড়লো। মেয়েটা কিন্তু হেঁটেই যাচ্ছে। এত শব্দে কিভাবে আমার ডাক শুনবে। তাই যেভাবে পারি পেছন পেছন দৌড়ানোর চেষ্টা করলাম। একটু কাছে যেতেই ডাকলাম, “এই মেয়ে,এই,শোনো, এই মেয়ে…” মেয়েটা কি আজব! আমার কথা যেন শুনতেই পাচ্ছে না। শুধু সামনে হেঁটে যাচ্ছে। হঠা কি ভেবে মেয়েটাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। আরো বাড়ছে। আমি মেয়েটার পেছন পেছন হেঁটে যাচ্ছি। তার কোনো খেয়াল নেই। সে খালি মাঠটার মধ্য দিয়ে খুব ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে। হঠা নিচে তাকাতেই দেখি লাল রঙা কিছু ছাপ। নিচু হয়ে দেখি , ঘাসের ওপর রক্ত । কোথা থেকে এলো!? বিস্ফারিত চোখে দেখি মেয়েটা যেদিকে হেঁটে যাচ্ছে, ঠিক সেদিকেই এমন রক্তের ছাপ রেখে যাচ্ছে। কি করব বুঝে পেলাম না। 

কিছুক্ষণ এমনি করে রক্তের ছাপটার কথা ভাবছিলাম। আবার দূরে কোথায় যেন কড়কড় করে বাজ পড়লো। আমি চমকে উদভ্রান্ত দৃষ্টি দিয়ে মেয়েটার দিকে তাকালাম। মনে হল যেন মেয়েটার ওপর দিয়েই বাজের আলো খেলে গেল। তারপর,তারপর কোথায় মেয়েটা!? আবার ছুটলাম, মেয়েটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল ঠিক সেখানে। কই? সেখানে তো সে নেই। কড়কড় শব্দে বাজ পড়লো দূরে কোথাও, আরো জোরে বৃষ্টি নামলো। 

আমাকে না পেয়ে মা বাইরে ছুটে এসেছিল ছাতা নিয়ে । আমি নাকি মাঠের মাঝখানে পড়েছিলাম। ঝুমিয়ে বৃষ্টি পড়ছিল আমার ওপর। কোনোমতে আমায় ঘরে এনে শুইয়ে দিয়েছিল। তিনদিন জ্বরে অচেতন হয়ে ছিলাম। মাঝে মাঝে চিকার করে উঠেছিলাম ঘুমের ঘোরে ,”এই মেয়ে, এই,শোনো, কোথায় তুমি, এই মেয়ে….”

তারপর আর কোনোদিন বৃষ্টিতে ভিজিনি। বৃষ্টির সময় জানালা খুলিনি কখনও, বন্ধ করে রেখেছি। বাজ পড়লে কানের ওপর হাত চাপা দিয়ে রেখেছি। এখনও মনে পড়ে, বৃষ্টিতে একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে…..ক্ষণে ক্ষণে বাজ পড়ছে…ঝুমিয়ে বৃষ্টি হচ্ছে…. আর ঘাসের ওপর রক্তমাখা পায়ের ছাপ…

রোদ্দুর..(শেষের গল্প)



মনের ভেতর অপরাধবোধের ছোটখাট একটা ঝড় বয়ে যেতে থাকে, নিত্যদিনের মত। এই দিন কয়েক ধরেই আমি রোদ্দুরের অপেক্ষায় থাকি, আর প্রতিদিনই ভিন্ন ভিন্ন কণ্ঠের আর্তচিকার রোদ্দুরের জন্য পরম আকাঙ্ক্ষাগুলোকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে থাকে। আমি নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকি, আর অপেক্ষা করি মনের এই অপরাধবোধের বিলুপ্তির জন্য। আর প্রতিদিনকার মতই, একটা নিয়মবাঁধা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে সিঁড়ি ধরে নেমে আসি, সেই আর্তচিকারের উস সন্ধানে।

মেঘদুয়ার ভেঙে সোনা রোদ সামনের সবুজ বাগানটাকে উদ্ভাসিত করে দিচ্ছে। দেখে মনের এতক্ষণের অপরাধবোধ সরে গিয়ে একরকম ভালোলাগা স্থান করে নিতে থাকে। কিছুক্ষণ সেই সোনা রোদে ‘সিক্ত’ ঘাস আর লতাগুলোর ঝলমলে রঙ এর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে যখন মনে পড়ে আমি কিসের জন্য নিচে নেমে এসেছি,তখনই এই ক্ষণিকের ভালোলাগাটা উবে যায়। এই আর্তচিকারের উসটা আমার জানা এবং আমি সেদিকেই পা বাড়াতে থাকি।

মিনিটখানেকের পথ। কিন্তু বিক্ষিপ্ত সব ভাবনা আমার চলার গতিকে স্থির করে দেয় প্রতিবারই। চিকারের উস আর কারণটা একেবারেই আনন্দদায়ক বা কৌতূহলোদ্দীপক নয়, কিন্তু আমি প্রতিবারই একরকম অসুস্থ কৌতূহল নিয়ে নতুন শিকারটাকে দেখতে যাই।

যেখানে এই নির্মম ঘটনাটা ঘটে থাকে প্রতিদিন, তার ধারেকাছে গেলেই তার চিহ্ন পাওয়া যেতে থাকে। বাতাসে জংধরা লোহার নোনা গন্ধ, আর পথে ফোঁটা ফোঁটা রক্ত জানিয়ে দিতে থাকে ভয়াবহ কিছু একটা ঘটে গেছে ওখানে। তবুও আমি এগিয়ে যেতে থাকি, ধীর, সামান্য ভীতসন্ত্রস্ত পায়ে। এতবার একই ঘটনা দেখবার পরেও আমার এই ভয়ার্ত ভাবটা কাটেনি। মোটামুটি নিঃশ্বাস বন্ধ করে এগিয়ে যেতে থাকি।

ক্রমান্বয়ে রক্তের ফোঁটাগুলো বিশালাকার হয়ে উঠতে থাকে আর আমি জানি, আরও একটু সামনে গেলে এটা একটা স্রোতের মত হয়ে দেখা দেবে। জংধরা লোনা গন্ধটা তীব্র হয়ে উঠতে থাকে, আর..

আমি শেষ পর্যন্ত সেখান থেকেই ফিরে যাই। আমি জানি, এটা একটা মানুষ, তার বিবেকের মৃত্যুচিকার আর তার রক্তক্ষরণের গল্প ছাড়া কিছুই নয়। কিন্তু আমি দেখবার সাহস করিনা। সময়ের পরিক্রমায় হয়ত আমার বিবেকেরও এরকম নির্মম রোদমাখা মৃত্যু ঘটবে, সেটা কি রকম হবে, আগে থেকে দেখবার সাহসটুকু আমার নেই। অসংখ্যবার এমনি করে অনেকগুলো বিবেকের মৃত্যু ঘটে। তার আর্তচিকার আদৌ আমাদের হৃদয়কে বিদীর্ণ কিংবা ভীত করে তুলতে পারে না। আমাদের যে সেই মৃত্যু দেখবার কিংবা উপলব্ধি করবার শক্তিটুকু নেই। তবুও আমি রোদ্দুরের অপেক্ষায় থাকি। মেঘভাঙা সোনা রোদের অপেক্ষায় থাকি। আমার প্রবল বিশ্বাস, সেই রোদ্দুর শুধু মানুষের বিবেকের মৃত্যুই নয়, নবজন্মও ঘটাতে পারবে…..



[এটাকে অন্য অনেকভাবেও শেষ করা যেত। এটা এক রকমের। আরও আইডিয়াগুলোকে প্রয়োগের ইচ্ছে থাকল। শুভেচ্ছা।]

রোদ্দুর..


বেলা প্রায় পড়ে এসেছে। দিন কয়েক ধরেই আকাশে মেঘের ভীষণ আনাগোনা। গুমোট আকাশ। এমন দিনগুলো আমার বরাবরই খুব খারাপ যায়, বিষণ্ণতা এসে মনের মাঝে ছায়া ফেলতে শুরু করে। আমি তখন কিছু একটা করতে করতে নিম্নস্বরে বলি, ও মেঘমালা, একটু সরেই যাও না, ওই যে, তোমার পেছনে সুয্যি অপেক্ষায় আছে আমার..একটু সোনারোদ আসতে দাও গো মেঘমালা, একটু রৌদ্র আসতে দাও..” শৈশবে আকাশে মেঘ করলেই মা বলতেন এ কথা। আমি একরকম অদ্ভুত বিশ্বাস নিয়ে আকাশপানে চেয়ে থাকতাম, আর কিভাবে যেন দেখতে দেখতেই মেঘ কেটে যেত। আর এই যে, আমি, দিন কয়েক ধরে রোজ দুপুরেই ধীরেলয়ে বলে যাই কথাগুলো, কিচ্ছুই যেন হয়না। মেঘগুলো আরও যেন আমাকে বিদ্রূপ করতেই আমার বাড়ির ছাদে কিংবা জানালার কাছে এসে দাঁড়ায়।

 

হঠাতই যেন একটু একটু করে বিষণ্ণতার দেয়াল চুইয়ে পড়া জলকণাগুলো ঝরতে থাকে। আপ্রাণ চেষ্টায় জলকণাগুলোকে আটকে রাখতে রাখতে উঠে দাঁড়াই। জানালার ধারে আইভি লতার ধারে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘমালাগুলোকে আবার বলি, ও মেঘমালা, একটু সরেই যাও না, ওই যে, তোমার পেছনে সুয্যি অপেক্ষায় আছে আমার..একটু সোনারোদ আসতে দাও গো মেঘমালা, একটু রৌদ্র আসতে দাও..” হাতের ওপর শীতল জলকণার স্পর্শ অনুভব করি হঠাত। সিক্ত আইভি লতার জল। কে জানে, হয়ত আইভি লতাও আজ মনে মনে একই কথা বলছে, “রৌদ্র আসতে দাও..”

 

মূহুর্তের নীরবতাটা দীর্ঘায়িত হতে পারত, আরও বেশি গভীর হতে পারত। যদি তীক্ষ্ণ কণ্ঠের আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করা চিকারটা না আসত। আমি যেন মেঘগুলোকেও কেঁপে উঠতে দেখি সেই চিকারে। আমার দিন কয়েকের অনুরোধে যে মেঘ সামান্যতম পরোয়া করেনি, সেই মেঘগুলোই যেন এই অজানা মানুষের চিকারে কেঁপে ওঠে, খানিকটা সরে যায়, রৌদ্র এসে স্থান করে নেয় সেই শূন্যস্থানে। আমার বেশ খুশি হয়ে ওঠার কথা। রৌদ্র যে আমার এই বিষণ্নতার অবসান ঘটাবে, কিন্তু মনের এক কোণে কোথায় যেন দীর্ঘদিন ধরে জমা করে রাখা একরাশ দীর্ঘশ্বাস বের করে দেয়। অমন রোদ্দুর তো আমি চাইনি। যে রোদ্দুর একজন মানুষের মরণের নিষ্ঠুর আগমনধ্বনি শোনায়, অমন রোদ্দুর তো আমি চাইনি। কেমন যেন স্বার্থপর হয়ে গেছি আমি। জানালার কাঁচ সরিয়ে আসা, আইভি লতা ছুঁয়ে আসা নরম রোদ্দুরের লোভে আমি কিভাবে ভুলে যাই যে, রোজ এই রোদ্দুরের দেখা পাবার অর্থ একজন মানুষের শেষ নিঃশ্বাস….

 

(চলবে)