পরাজিত


জীবনে পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম খুব ছোটবেলায়। ক্লাস ফাইভে। সবচে প্রত্যাশিত ক্যাণ্ডিডেট হয়েও সেবার কেন যেন পেলাম না। মেরুদণ্ডটাই ভেঙে গেছিল। যার পর থেকে স্কুল কলেজে শত ভালো রেজাল্ট করেও নিজেকে কোনোদিন ভালো ছাত্রী হিসেবে স্বীকার করতে পারিনি। আমি তো জানি, আমি তা নই।

সেই ভাঙা মেরুদণ্ড জোড়া লাগতে সময় লেগেছিল প্রায় ছয় বছর। তবুও কোনোদিন স্বীকার করিনি যে আমি ভালো ছাত্রী। আমি ভালো পারি। ভালো বুঝি। ভালো জানি। শুধু পড়ে যেতাম। কী করব, আর কিছু যে করার ছিল না।

২০১২ এর শেষে বড়সড় ধাক্কাটা খেয়েও হার মানিনি। বিধ্বস্ত শরীর আর মন নিয়ে চালিয়ে গেছিলাম। নিজের পরিশ্রমের উপর আস্থা ছিল। ভেবেছিলাম, পরিশ্রম দিয়েই সব জয় করা যায়। আমার শ্রেষ্ঠতম ভুল ভাবনা।

২০১৪ এর দুই তৃতীয়াংশে এসেও একইভাবে ধাক্কা খেলাম। পরপর দু বার। পাবলিকে পড়ার আশাটা বিসর্জন দিতেই হল।

পরিশ্রম দিয়ে সব জয় করা যায়- এ প্রকৃতপক্ষে অমেধাবীদের উদ্দেশ্যে মেধাবীদের সান্ত্বনাবাক্য মাত্র। মেধাবীদের ভদ্রতা আর উৎসাহের ছলে বিদ্রূপমাত্র। বিষয়টা সত্য যে নয়- এ আমি বহুবার দেখেছি। বহুবার হতাশায় আচ্ছন্ন করেছে আমাকে।

প্রশ্ন হল, কী পেলাম আমি অবশেষে। হয়ত বা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি হার না মানার ক্ষমতা। কিন্তু শেষমেষ সাফল্য জিনিসটা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। পরাজিত করে গেল কাঠপুতুলকে।

তবু জীবন থেমে থাকে না। থাকবে না। ঘড়ির কাঁটা আমার বিষাদে স্তব্ধ হয়ে যাবে না। সূর্য আমার হতাশা আর কষ্টে সমব্যথী হবে না। তাদের নিয়ম মেনেই চলতে হবে। আমারও তাই থেমে থাকবার উপায় নেই। হয়ত বিধাতার এই ইচ্ছে। আর্কিটেকচার নিয়ে পড়া। হয়ত ওতেই আমার সাফল্য লুকিয়ে আছে। কে জানে!

বিধাতার প্রতি আমার নিদারুণ অভিমান। তিনি বলেন, ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিতে হয়। আমি আমার সর্বোচ্চটুকুই দিয়েছিলাম। তবুও তো আপনজনদের ইচ্ছেপূরণ করতে পারলাম না। তবে আমি কিভাবে নিজের ভাগ্যকে গড়ে নেবো?

তবে এটুকু শিখে নিলাম, বিধাতা পরিশ্রমের কোনো মূল্য দেন না। হয়ত বা বিধাতা বলেই কিছু নেই। যদি বা থাকতোই, তবে এমন নিদারুণ নিষ্ঠুর তিনি কিভাবে হতে পারেন?

কে জানে!

লেখাটা কেমন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, জীবনটাই তো কেমন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যাচ্ছে। হয়ত আরো যাবে। হয়ত এমন করেই ভেঙেচুরে গড়ে উঠবে অন্য এক কাঠপুতুল।

কি বিচিত্র আশাবাদী হয়ে উঠেছি দেখেছ রোদ্দুর?

তবু শেষমেষ কাঠপুতুলের পেছনে একটা ছোট্ট বিশেষণ যোগ করে দেওয়াই যায়।

পরাজিত।

লজ্জিত।

সত্যিই, কী ভীষণ লজ্জিত আর ক্ষুদ্রই না লাগছে নিজেকে। হয়ত তাই আন্তর্জালিক সব যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরে গেলাম চুপচাপ। ফেসবুক স্থায়ীভাবে মুছে ফেলবার আবেদন করলাম। স্রেফ কাঠপুতুল আর ফ্লিকার। পুরনো মানুষদের মুখোমুখি আর হতে চাই না। তারাও যদি আর মুখোমুখি না হয়, তবেই সুখী হই, কৃতজ্ঞ হই। সত্যি বলতে মুখোমুখি পড়ে গেলে আমার আর লুকোনোর জায়গা থাকবে না।

কী দুঃসহ লজ্জা!

অষ্টাদশীর জীবনদর্শন


প্রফেসর মতিউর রহমান মোল্লা’র চেম্বারে অপেক্ষা করছিলাম। প্রায় দুই ঘণ্টা। কিছুক্ষণ পর পেশেণ্টদের ডেকে নেওয়া হল ভেতরে। আমিও গেলাম। একাই। অপেক্ষা করছিলাম অন্য চারজনের সাথে। প্রথমজন ছিলেন একজন বৃদ্ধা আর তার ছেলে। কিছুক্ষণ পরীক্ষানিরীক্ষা করে ডাক্তার বৃদ্ধাকে বাইরে বসতে বললেন। ছেলের উদ্দেশ্যে বললেন, “আপনি জানেন, উনার কী হয়েছে?” ভদ্রলোকের বয়স বেশি নয়। একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, ‘স্যার, অনেকেই বলেছে। এখন আপনি যা বলেন, আমি মেনে নিতে পারব। আপনি বলেন’। ডাক্তার জানালেন, ‘ক্যান্সার। মুখের অনেকখানি জায়গায় ছড়িয়ে গেছে’।

জীবনে প্রথম বোধহয় সামনাসামনি এরকম কোনো ঘটনার সম্মুখীন হলাম।  খুব বেশি সময় বিহবল থাকতে পারিনি, আর একজনের পরই আমার ডাক পড়লো।

জীবনটা যে ভয়াবহ কঠিন, তা মাত্রই নজরে পড়তে শুরু করেছে।  খুব খুব ইচ্ছে করে সবকিছু ফেলে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের উপর একলা বসে থাকি। বাতাসের গান আর মেঘের ছোঁয়াছুঁয়ি দেখবো সারা সকাল, পা ঝুলিয়ে বসে। দুপুরটা ঘুরে বেড়াবো অরণ্যে। সন্ধ্যেয় ফিরে আঁধারের মাঝে আলো খুঁজবো অসীমে দৃষ্টি মেলে দিয়ে, জোনাকির সাথে সখা পাতাবো। রাতটা ঘুমোবো।  নিশ্চিন্তের ঘুম। যা কখনও পাইনি। দুশ্চিন্তা আর পরদিনের কর্মপরিকল্পনা তাড়া করে ফেরে যে সবসময়।

কবে হারাতে পারবো কে জানে!

আশাপূর্ণা দেবীর ‘নির্জন পৃথিবী’ পড়ছিলাম আবারও। প্রতিবার পড়বার পরে এক অদ্ভুত বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হই। সত্যিই, কেমন লাগবে, যদি কখনও আবিষ্কার করি, যা কিছুর জন্যে ছুটে চলেছি, সেসব কিছুই আমাকে সুখ দিতে পারবে না? নিরূপার অনুভূতিগুলো আমাকে খুব আক্রান্ত করে। কখনও যদি আবিষ্কার করি, অরণ্যসখা আমি যেমন চাই, তার ঠিক উলটো? কাব্যিক অনুভূতির কণামাত্রও তার নেই? কিংবা এত এত বইপত্রে মুখ গুঁজে থাকা, তার সবই যদি এ বছরের শেষে ব্যর্থ আবিষ্কার করি? এ যে স্রেফ পৃথিবী চোখের সামনে ধ্বংস হয়ে যাবার সমান!

ছোট থাকতে খুব বড় হতে চাইতাম। মনে হত, বড় হওয়াটাই তো ভালো। কোনো বাধা নেই। কোনো নিষেধ নেই। স্রেফ নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণ করে চলতে হয়। এখন বোধ হচ্ছে, বড় হওয়াটা অভিশাপ। বেড়াজালের মধ্যে আটকে যাওয়া।  বাধা থেকে মুক্ত হতে গিয়ে আরো বেশি বাধার সম্মুখীন হওয়া।

হয়ত ইদানিং শিশুসুলভ মুখশ্রীটা হারাচ্ছি। অপরিচিতরা সবাই আপনি করে সম্বোধন করছে। খুব অস্বস্তি লাগে তখন। কৈশোর থেকে তারুণ্যে পা দেবার এই সময়টা ভয়াবহ। অদ্ভুত। বিষণ্ণ।

হুম, বিষণ্ণ। হুটহাট বিষণ্ণতা বোধহয় এই বয়সটাতেই আক্রান্ত করে। সে বিষণ্ণতা থেকে মুক্তি নেই কোনো। আশাভঙ্গের হতাশাও মারাত্মক। আমি যেমন হতাশ হলাম গত ৬ তারিখ। মেডিকেল বোর্ড জানালো ক্ষত থেকে আমার মুক্তি নেই। প্রথমে খুব স্বাভাবিকভাবে নিলাম। নানা ভাবনায় মনকে ঘুরিয়ে রাখলাম। রাতে আর বাঁধ মানলো না।  এরপর থেকে এ ডাক্তার থেকে ও ডাক্তারের কাছে। দিনকয়েকের মধ্যে প্লাস্টিক সার্জনের কাছে যাবো।  দেখা যাক, সে কী বলে।

এটুকু ভেবেই খারাপ লাগে যে জীবনে কোনোদিন শখ করে কিংবা স্বাভাবিক বয়োসজনিত প্ররোচনা থেকেও সাজসজ্জার দিকে মন দিইনি। যার ফলস্বরূপ প্রায় তারুণ্যে পা দিতে এসেও সেসবের কিছু জানি না। একদমই কিছু জানি না। স্রেফ গুছানো থাকতে চাইতাম সবসময়। তাতেও ভাটা পড়লো। আমি যা করতে চাইবো, তার সবকিছুতেই কি ভাটা পড়বে এভাবে? অরণ্যসখার হাত ধরে যখন হাঁটা শুরু করবো, তখন কাঁটা পড়বে পথে? যখন একলা চলতে শুরু করব, তখন পথ হারাবো?

জীবনটা এত জটিল কেন? জীবন কি আরেকটু নির্বিঘ্ন হতে পারতো না? 

Tomorrow Is Today


লিখতে লিখতে এই ইন্সট্রুমেন্টালটা শুনছিলাম। ইচ্ছে করলে শোনা যেতে পারে। খুব কম ক্ষেত্রেই লেখকের স্থানে নিজেকে অনুভব করা যায়। হয়ত মিউজিকটা লেখার অনুভূতির সাথে পাঠককে পরিচিত করে দিতে পারে।

 

আমি কখন লিখি? যখন সবচেয়ে অস্থির থাকি। অনুভূতিগুলোকে প্রকাশ করবার মতো কোনো মানুষ নেই, যাকে শোনালে সে মন দিয়ে শুনবে, হুম হাম করে উড়িয়ে দেবে না। তাই কাঠপুতুলকে শোনাই। লেখাগুলো তাই অস্থিরতায় সিক্ত থাকে। টুপটুপ করে গড়িয়ে পড়ে অষ্টাদশীর অস্থিরতার ফোঁটা!

শেষ মুভিটা ছিল টুমরো ইজ টুডে। সপ্তদশবর্ষীয়া কিশোরীকে কেন্দ্র করে তৈরি। সমুদ্রতীরে আত্মহত্যা করতে যায় গ্রেগ, যে কি না দুর্ঘটনায় হারিয়েছে তার স্ত্রী আর অনাগত সন্তানকে। কিন্তু ভুল সময়ে ডুবতে চেষ্টা করায় সমুদ্র তীরে পড়ে থাকে গ্রেগ। তাকে খুঁজে পায় জুলিয়া, যার নামকরণ করেছে তার মা, জুলস ভার্নের নামানুসারে।  গ্রেগের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বাঁচায় জুলিয়া। গ্রেগের জীবনকাহিনী জানতে পেরে জুলিয়া সিদ্ধান্ত নেয় তাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট করবার। একদিন জুলিয়া সুপার শপে গিয়ে শুনতে পায় গ্রেগকে খুঁজছে পুলিশ, এ্যারেস্ট করবার জন্যে। জুলিয়া তাই গ্রেগকে লুকিয়ে রাখে। ক্রমে ক্রমে গ্রেগ আর জুলিয়া চমৎকার বন্ধু হয়ে ওঠে, বয়সের বিশাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও।  কিন্তু গোল বাঁধে যখন জুলিয়া সরল মনে বন্ধু গ্রেগকে বাড়ি নিয়ে আসে। জুলিয়ার সৎ মা গ্রেইস ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। প্রশ্ন করে, এত বড় মানুষটা কিভাবে তার বন্ধু হয়, আর যাকে তাকে বাড়ি নিয়ে আসার মানেই বা কি। মা’র সাথে জুলিয়ার বিরোধ সৃষ্টি হয়।  জুলিয়ার বাবাকে গ্রেইস বিষয়টা জানালে বাবা জুলিয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করে। জুলিয়া যখন বলে, গ্রেগ চমৎকার একজন মানুষ, বাবা বলে,

“ Everybody is nice when they want something “

অতএব জুলিয়া গ্রেগের সাথে বাবা-মার চোখের আড়ালেই রাখার চেষ্টা করে। গ্রেগ আত্মহত্যা করবে বলে ঠিক করলে জুলিয়া জানায় দুইদিন পরই তার জন্মদিন। কাজেই সে আত্মহত্যা করতে পারবে না এখন। জুলিয়া যেখানে জীবন নিয়ে পজিটিভ, গ্রেগ প্রত্যুত্তরে তাকে প্রশ্ন করে, সপ্তদশবর্ষীয়া এক বালিকা জীবন বিষয়ে কীইবা জানে? টুমরো টুমরো করে জুলিয়া তার আত্মহত্যার দিনগুলো পিছিয়ে দেয়। গ্রেগ তাকে মনে করিয়ে দেয়, ‘টুমরো ইজ টুডে!’

এদিকে জুলিয়ার সিক্রেট এডমায়ারার জুলিয়ার মন না পেয়ে জন্মদিনের রাতে আবিষ্কার করে, জুলিয়া গ্রেগের সাথে জন্মদিন কাটাচ্ছে। ঈর্ষান্বিত হয়ে পুলিশকে জানিয়ে দেয়। গ্রেগ এ্যারেস্ট হয়। জুলিয়া জানতে পেরে বাবাকে অনুরোধ করে তাকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করতে। বাবা শর্ত জুড়ে দেয়, জুলিয়া আর গ্রেগের সাথে দেখা করতে পারবে না। জুলিয়া মেনে নেয়। গ্রেগের সাথে জুলিয়ার বন্ধুত্বের এখানেই ইতি।

দশ মাস পর জুলিয়ার বাবা গ্রেগকে ফোন করে ফিরে আসতে বলে। জুলিয়া তার মায়ের থেকে জন্মসূত্রে প্রাপ্ত অসুখে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী তখন। গ্রেগ ফিরে আসে। (এখানে চিত্রায়নটা হৃদয়-ছোঁয়া)। জুলিয়ার জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে বন্ধু গ্রেগের সাথে। অবশেষে জুলিয়া মারা যায়।

বয়সের বিশাল পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও গ্রেগের সাথে জুলিয়ার এই সম্পর্কটা একটু অন্যরকম। না ঠিক বন্ধুত্ব, না ঠিক প্রেম, না স্বার্থের কোনো সম্পর্ক। হয়ত জুলিয়া আর গ্রেগ চমৎকার বন্ধু হিসেবে থাকতে পারতো। কালের পরিক্রমায় হয়ত হয়ে উঠতে পারতো একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু চারপাশের মানুষগুলো তাদের হারানো মানুষগুলোর স্মৃতি স্মরণ করে জুলিয়াকে রক্ষা করতে গিয়ে মূলত জুলিয়াকে নিঃসঙ্গই করে তুলেছিল। তারা চায়নি জুলিয়া আঘাতপ্রাপ্ত হোক। কিন্তু চারপাশের মানুষের জটিলতা জুলিয়ার সরল মনকে বুঝতে চায়নি। জুলিয়া আর গ্রেগের বন্ধুত্বকে তারা সহজে গ্রহণ করতে চায়নি, বয়সের ব্যবধানের কারণে।

মুভিতে কিছু কিছু লাইন খুব ভালো লাগল।

“The mind grows old, the heart never forgets”

সত্যিই তো, মন সময়ের সাথে সাথে বুড়ো হয়ে যায়, অভিজ্ঞতালব্ধ হয়ে পরিপক্ব হয়ে ওঠে। কিন্তু অনুভূতিগুলো কখনও মুছে যায় না। অবচেতনে হলেও থেকে যায় অতলে।  তবে ব্যক্তিবিশেষে অনুভূতিগুলো কখনও তিক্ত, কখনও মধুর হতেই পারে। কালো গোলাপ সবার কাছে সুন্দর না হতেই পারে, তাই বলে অন্যের অনুভূতিকে আমরা বাধা দিতে পারি না। জুলিয়া যেমনটা চেয়েছিল, উজ্জ্বল দিকটুকুকে ধরে গ্রেগকে হতাশা থেকে তুলে আনতে, সরল মনে; কিন্তু চারপাশের মানুষের তিক্ত অভিজ্ঞতা জুলিয়াকে বাধা দিয়েছিল। যদিও গ্রেগ ছিল নিরপেক্ষ। স্রেফ আশঙ্কা থেকে আমরা কত সম্ভাবনাকে চাপা দিই, না?

“Everybody is nice when they want something.”

এই বাক্যটাকে নিয়ে চারপৃষ্ঠা লেখা সম্ভব। সামাজিক বিধি অনুযায়ী অপরিচিতের সাথে রূঢ় ব্যবহার করা সঙ্গত নয়। তবে বোধহয় সাধারণ একটা মাপকাঠি, ভদ্রতার মাপকাঠি আমরা রাখি। কিন্তু যার সাথে স্বার্থ, তার সাথে তো সদাসর্বদাই ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখতে হয়। স্বার্থটা যে কেবল পার্থিব হবে, তা নয়। হতে পারে অপার্থিব। হতে পারে মায়া, হতে পারে সঙ্গ, হতে পারে স্রেফ সময় কাটাবার জন্যে। সত্যিই তো, যখন আমরা কিছু চাই, তখনই কেবল কৃত্রিম ভালোত্বের একটা মুখোশ পরে থাকি!

“Some people have a second chance, some never have a first. Others are angels.”

জীবন কখন ঠিক পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে, জানা আছে কাঠপুতুল? জীবন কি আদৌ কখনও পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে? হুট করেই তো আমরা মরে যাই। হারিয়ে যাই। মুছে যাই।  মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যিই, দ্বিতীয়বার যদি সুযোগ পেতাম, তবে হয়ত নতুন করে সাজাতাম জীবনটাকে। কেউ কেউ সুযোগটুকু পাই, ভিন্ন রূপে। কেউ কেউ সুযোগটুকুও পাই না। তবে কিছু মানুষের জীবন নেহাৎই পরিপূর্ণ। যাকে বলে নিখুঁত। শ’য়ে একজন হয়ত এমনটা খুঁজে পাওয়া যাবে। জীবনটা বিধাতা তাদের নিজ হাতে সাজিয়ে দেন। লাইফ অফ এ্যাঞ্জেলস।  নিখুঁত অথবা পরিপূর্ণ।

আমার ক্ষেত্রেও কি তাই হচ্ছে না? চারপাশের মানুষ এমনভাবে আঁকড়ে আছে, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় কখনও কখনও। মা বলে, জীবন সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। অস্বীকার করি না। কিন্তু জীবনকে দেখবার কোনো সুযোগ কি আমাকে কখনও দেয়া হয়েছে? এ তো বইয়ের দুটো পাতা নয় যে বছর দুয়েক পড়লেই শিখে যাবো জীবনের মর্মার্থ, শিখে যাব কিভাবে অপ্রাপ্তিকে এড়াতে হয়, এড়াতে হয় বিষাদ, কিংবা থাকব অনাহত। আমিও বুঝি, চারপাশের মানুষদের অতি ভালোবাসাই এজন্যে দায়ী। কিন্তু কখনও কখনও যে মন বিদ্রোহ করে বসে। ওপর শান্ত মূর্তি নিয়ে, ভেতরে অস্থিরতায় ক্লান্ত হয়ে যাই।

মুভিটা ইউটিউবে দেখতে নিচের লিঙ্ক অনুসরণ করতে পারেন। 

উপলব্ধি


গল্প

সকালের আবহাওয়াটা যে এত সুন্দর, কাল যদি না বেরোতাম, জানতামই না হয়ত। কাল বেরিয়েছিলাম রমনা পার্কে হাঁটতে। প্রায় সাড়ে ছ’টার সময়। বাসা থেকে হেঁটে গেলে পনের মিনিটের পথ। অথচ কখনই এত সকালে যাওয়া হয়নি। হাতের কাছে অমৃত পেলে তাকে যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করাই আমাদের ধর্ম!

ক্যামেরা ছিল সাথে। তবে তুলবার মত চোখ আমার নেই কি না, তাই কিছু তুলতেও পারিনি। তবে পুরো রমনা পার্কটা এক চক্কর দিয়ে আসাটা অন্যরকম এক আনন্দ। প্রায় এক ঘণ্টা হেঁটে নতুন জুতোয় অবশ্য পায়ে ফোসকা পড়ে গেছে, অনভ্যস্ততায় খানিক ব্যথাও বটে, তবে অনুভূতিটা চমৎকার। ছোট ছোট বাচ্চারাও বাবা-মার সাথে দুমদাম করে হেঁটে যাচ্ছে, কেউ আবার দোলনায় আকাশ ছুঁতে চাইছে! সকালের এই হাঁটিয়েদের মধ্যে বোধহয় একরকম বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। চলতে চলতে হঠাৎ পরিচিত কারো দেখা পেয়ে হাত মেলানো বা কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সহজলভ্য। তবে খারাপ লাগলো পার্কের দুরবস্থা দেখে। লেকে জলশূন্য বলা চলে, গাছপালার অবস্থাও তেমন ভালো নয়। শহরের বুকে এক টুকরো সবুজকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের এত অনীহা কেন?

রমনা পার্ককে ঘিরেই একটা গল্প লিখে ফেলা যায়। গেটের মুখে ছোটখাটো বাজার, কিংবা চায়ের দোকান, বা পত্রিকার দোকানে আজকের খবর জানতে কৌতূহলী গোটাকয়েক মুখ, বাচ্চাকে কাঁধে নিয়ে হেঁটে বেড়ানো বাবা, সাইকেল নিয়ে আসা শিশু, হঠাৎ পরিচিত মানুষের দেখা পাওয়া, বন্ধুত্ব, শরীরচর্চার নিয়মহীন ভঙ্গিমা ছিন্নমূল মানুষদের বিস্ময়মাখা দৃষ্টি কিংবা রাতভর ভেজা ঘাসের ওপর পড়ে থাকা কিছু গোলাপের পাঁপড়ি –সবকিছু মিলে চমৎকার কোনো গল্প হয়ে উঠতে পারে। হায়, যদি আমি গল্প লিখতে জানতাম!

আজও যাব হাঁটতে। বোধহয় শুক্রবার পর্যন্ত রোজই। এরপর মা’র অফিস শুরু হয়ে যাবে, আর যাওয়া হবে না। বিষাদ! বিষাদ!!

-অন্তর্জালবিহীন জীবন-

একে হয়ত ঠিক অন্তর্জালবিহীন জীবন বলা চলে না, তবে আগের তুলনায় অনেকাংশেই অন্তর্জালের মানুষগুলোর প্রতি মায়া কেটেছে বলা চলে। এবং ক্ষেত্রবিশেষে মনে হয়, জীবনটাকে উপভোগ করছি আক্ষরিক অর্থেই। ফেসবুকে ঢুকলেই মনে হয় সবাই কোনো না কোনো বিষয় নিয়ে ক্ষিপ্ত, তর্কে কে কত বেশি পারঙ্গম, তাই দেখাতে ব্যস্ত। অথচ যেখানে এই অন্তর্জালিক তর্কে পৃথিবীর কারো কিছুই এসে যাবে না। সেসব অর্থহীন তর্ক নেহাৎ তিক্ততাই বাড়াবে পারস্পরিক সম্পর্কে। মনন চর্চা কি বলা চলে একে? কেউ কারো মুখোমুখি না থাকায় অনায়াসে তাকে আহত করতে পারি, দ্বিধা হয় না। সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুটিও বন্ধুত্বের দায়ভার এড়িয়ে চুপচাপ বিপক্ষের কথায় সায় দিতে যেতে পারি, যেটা হয়ত বাস্তবে কখনই করতো না। মুখোমুখি বসা নেই বলে বুঝতে পারি না, আহত মানুষটির মন কিংবা কোন পরিপ্রেক্ষিতে তারা কোনো কথা বলছে। ঈর্ষা জাগানিয়া ছবি দেখে মন বিষাদে পরিপূর্ণ করাও বিরল নয়। আমরা হয়ত খুব সহজে নিজের আনন্দের কথাটুকু জানান দিচ্ছি সবাইকে, কিন্তু অপর পাশে একই আনন্দের অভাবে কেউ ভাষা পাচ্ছে না বিষাদ প্রকাশের।

যেমনটা আমি। ফেসবুকের মানুষদের ঘুরোঘুরির ছবি দেখে আহত হই। কখনও ভাবি, বলব, প্রকাশ করার আগে আমার চোখে যেন না পড়ে, সেই ব্যবস্থা করতে। কিন্তু এও ভাবি, তাদের কি দায় পড়েছে বিষাদের স্পর্শ থেকে আমাকে দূরে রাখবার? কিংবা কোনো সহপাঠীর স্পিচ কম্পিটিশন জয়ের খবর খানিক আনন্দ দিলেও তার শতভাগেই বিষাদ তার বক্র তুলি বুলিয়ে যায়। আর আমি অবশ চোয়াল নিয়ে কিছু করতে পারব না আগামী বছরও, সেই বিষাদে আক্রান্ত হই, ভাবি দুর্ভাগ্যের কথা।  কিংবা কিছু বড় মানুষরূপী শিশুর কথা। যে কি না একবার জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে জানিয়ে দেয়, আমি তার মতবাদের বিরুদ্ধে কোনো শব্দোচ্চারণ করতে পারব না। কি দুর্ভাগ্য! ভাবছি, কারো কাছ থেকে যথাসম্ভব উপকার নেবো না। যদি নিই, তবে তাকে জিজ্ঞেস করে নেবো, উপকারটুকুর বিনিময়ে আমাকে কতখানি সুদ গুণতে হবে, কিংবা কত বছর নিজের কী কী স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে হবে! কিংবা প্রিয় কোনো মানুষের কথা। যাকে নিত্যদিন স্ট্যাটাস দিয়ে তটস্থ করে রাখা হত, সেও তার অনুপস্থিতিতে বিন্দুমাত্র বিচলিত নয়।

সত্যিই, ক্ষেত্রবিশেষে বাবা হয়ত ঠিক কথাই বলে। বড়দের মাঝে যে জটিলতা আর কুটিলতা উপস্থিত, তার মুখোমুখি হবার মত শক্তিশালী আমি নই। আমি দুর্বল, অনুভূতিপ্রবণ এবং naïve. সেজন্যেই হয়ত পৃথিবী দেখবার স্বাধীনতাটুকু পাই না। চুরচুর হয়ে ভেঙে পড়ব বলে। কাঠপুতুল যে আমি। বইপত্রে মুখ গুঁজেই দিন কাটাই বরং।

হয়ত ওপরের কথাগুলো মেনে নেওয়া খানিক শক্ত। তবে কথাগুলো বাস্তব। সপ্তাহ দুয়েক ফেসবুকের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকলে বোধ করি পার্থক্যটুকু বোঝা সম্ভব।

সোজা কথায়, অন্তর্জালের মানুষ কখনই আপন হতে পারে না। প্রতি মুহূর্তে যাদের সাথে মুখোমুখি বসে সময় কাটানো হয়, তাদের সাথে ঘনিষ্ঠতার এক ভাগেরও সমান ঘনিষ্ঠতা তাদের সাথে গড়ে ওঠে না। যা গড়ে ওঠে, সেটা কৃত্রিমতা ছাড়া কিছু নয়। একেবারেই নয়। উপযুক্ত সময়ে সে কৃত্রিমতাটুকু প্রকাশিত হয়ে পড়ে। আহত হই, যারা আমার মত দুর্বল, যারা আক্ষরিক অর্থেই ভেবেছিলাম, মায়ার উপস্থিতি আছে এখানে।  সবশেষে চুপচাপ সরে যাওয়া ছাড়া কিছু করবার থাকে না।

সত্যিই, একেকসময় কি ভীষণ নিঃসঙ্গ লাগে। কোনো প্রিয় বন্ধু নেই। প্রিয় মানুষ বলে যাদের অভিহিত করি, তাদের থেকেও একজন খসে পড়েছে, আর একজন কতদিন টিকে থাকবে, তার ঠিক নেই। মাঝরাতে কারো ঘুম ভাঙিয়ে গল্প করবার অধিকার নেই কারো ওপর। অথচ আমি সে অধিকার দিয়ে রেখেছি সবাইকে। কাউকে হুটহাট বলা চলে না, “চলো, দেখা হয়নি অনেকদিন, দেখা করি!” কিংবা কারো জন্যে বিশেষ কোনো দিনের বিশেষ কোনো উপহার খুঁজতে খুঁজতে ক্লান্ত হতে পারি না।  মানুষ এত জটিল কেন, কাঠপুতুল? নাকি আমিই জটিল? তাই কারো প্রিয় হয়ে উঠতে পারি না? সেও হতে পারে। আমিই মন্দ। সেজন্যেই অধিকার নেই কোনো।

“আমি আর কতোটুকু পারি ?

কতোটুকু দিলে বলো মনে হবে দিয়েছি তোমায়,
আপাতত তাই নাও যতোটুকু তোমাকে মানায়”।

-পৃথক পাহাড়/ হেলাল হাফিজ

এই তো। দিনলিপি এখানেই শেষ। কাঠপুতুল এদিকে ৭০০০ বার দেখা হয়েছে, সে খবরটাও পেলাম স্ট্যাটসে। হয়ত পাঠক দু একজন, তারাই ঘুরেফিরে দেখেছেন।  লিঙ্ক বদলে দিয়েও এড়াতে পারিনি। সময়ের এতটা অপচয় করবার মত মানুষও আছে তাহলে, এই স্বার্থপর সময়েও?

 

ক্ষত


-ক্ষত-

‘তুমি অসুস্থ মানুষ, তোমার এত কষ্ট করতে হবে না। আমি মানগুলো বলে দিচ্ছি, লিখে দিয়ে খাতা জমা দিয়ে চলে যাও!’ আমি ভীষণ অবাক হয়ে তাকালাম ল্যাব এ্যাসিস্ট্যান্টের দিকে। উনি তখনও বলে চলছেন, ‘দ্যাখো, এটা আঠারো, আর এটা ষোলো। বাকিগুলা হিসাব করে বসিয়ে দাও। জলদি!’

মুখে কি বিষাদের ছায়া পড়েছিল স্পষ্ট? নাকি কেবল মনটাই বিষাদের ছায়ায় শীতল হয়ে উঠছিল? আমার জানা নেই। আয়না থাকলেও বলতে পারতাম কি না সন্দেহ। মুখ দেখে আমার অনুভূতি কেউ কি আদৌ কখনও বুঝতে পেরেছে? আমি নিজেও যে পারব, তার নিশ্চয়তা কী?

ঠোঁটের পাশের ক্ষতটুকু আমাকে এভাবেই ভোগাচ্ছে নিত্যদিন। হয়ত ঠোঁটের অনুভূতিহীনতা আমাকে কষ্ট দেয় না, কেবল খানিকটা বাধা দেয় হাসতে, কিংবা সদ্য জেগে ওঠা স্পিচ কম্পিটিশনে অংশ নেবার ইচ্ছেটুকুকে; কিন্তু কষ্ট দেয় মানুষের এই করুণাটুকু। আমি দুর্বল। কিন্তু দৃশ্যমান কোনো ক্ষত আমাকে দুর্বল করতে পারে, এতখানি দুর্বল তো আমি নই।

ল্যাব থেকে বের হয়ে সহপাঠিনীর জন্যে অপেক্ষা করছিলাম।  অথচ অনায়াসে বাড়ি চলে যেতে পারতাম। সকালে রিকশা না পেয়ে হেঁটে হেঁটে কলেজে আসবার ক্লান্তিটুকু বোধহয় মুখে লেগে গেছিল। ঘামে মুখ সিক্ত, চুল অবিন্যস্ত, সানস্ক্রিনের সাথে মিশে বোধহয় মুখটা খানিকটা লালচেও বটে। চুলগুলো ছোট বলে এমনিতেই সামলে রাখতে পারি না, তার ওপর মাথার কপালের ওপর থেকে সার্কেল করে বিশাল কাটা দাগ। চুলগুলো সামনে দিয়ে রাখতেই হয় ওটা ঢেকে রাখতে, যদিও এটা আমার পছন্দ নয় কোনোদিনও। কিন্তু এখন যে বাধ্যবাধকতা এটাই। ঘামে ভিজে, বাতাসে উড়ে এলোমেলো হয়ে ছিল চুলগুলো। ক্ষতটাও খানিক স্ফীত হয়ে গেছিল বোধহয় ক্লান্তিতে। দেখে এক সহপাঠিনী প্রশ্ন করল, ‘তোমার কি এই দাগটা আর যাবে না?’ আমি হাসার চেষ্টা করে বরাবরের বাঁধা উত্তরটুকু দিই। ‘ডিসেম্বরে ডাক্তার যেতে বলেছে’, ‘বয়স কম’, ‘হয় ইনজেকশান নয় সার্জারি’, ‘কিন্তু আগের থেকে তো কালচে ভাবটা কম’ ইত্যাদি।

সহপাঠিনী সরে যেতে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। ক্লান্ত লাগে খুব। প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে।

পরী’ও দুর্ঘটনার পরে বলছিল যে সবচে আফসোসের বিষয় হল আমার সারা শরীরে কোথাও এতটুকুও আঘাত লাগেনি, সবটুকু গেছে মুখের আর মাথার ওপর দিয়ে। সাথে খানিক স্বস্তি মিশিয়ে বলেছিল, মাথার চামড়া যতখানি উলটে গেছিল, তাতে ব্রেইন ড্যামেজ কেন হয়নি, সেটাই অস্বাভাবিক বিষয়। নিতান্ত ভাগ্যের জোরেই টিকে গেছি নাকি।

তবুও আমার ভাবতে ইচ্ছে করে, মুখটুকুকে রেহাই দিয়ে না হয় হাত ভাঙত, পা ভাঙত। মাসদুয়েক শুয়ে বসে কাটাতাম। সেও হয়ত সয়ে যেত। প্রশ্নবাণ যে খুব তীক্ষ্ণ, কাঠপুতুল। তারচে ভাঙা হাত পায়ের ব্যথা সহ্য করা হয়ত সহজ।

প্রায় এক বছর হতে চলল। মানুষের কৌতূহলী চোখ এখনও দেখতে পাই। তবে ততটা আর আহত করে না, যতটা করেছিল প্রথম দিন। এক্সাম ফেলে মানুষজনের তাকিয়ে থাকাটা প্রবলভাবে আহত করেছিল সেবার। পুনরাবৃত্তি করবো না। কাঠপুতুলের অলিগলির দেয়ালেই কোথাও আছে হয়ত।

তবে এইটুকু ক্ষত যে জীবনে কতকিছু শিখিয়েছে আমাকে, তার হিসেব নেই। মানুষকে অগ্রাহ্য করতে শেখা, মানুষের বিরক্তিকর প্রশ্নের হাসিমুখে উত্তর দেয়া, মেনে নেওয়া, অল্পে তুষ্ট থাকা- ইত্যাদি ইত্যাদি। বিধাতা আমাকে এভাবেই শেখান। খুব আঘাত দিয়ে। চিরজীবনের মত শেখান সত্যগুলো।

তবে তাই হোক। হৃদয়ের ক্ষত আর দৃশ্যমান ক্ষত নিয়ে আমি হয়ে উঠি কোনো ঐশ্বরিক কলমের খোঁচায় পুরনো হয়ে ওঠা কাগজমাত্র!

-দিনকাল-

আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসসমগ্র প্রায় শেষ করে এনেছি। ‘প্রতীক্ষার বাগান’ পড়ছি এখন।  আমি তো রিভিউ লিখতে জানি না, তবে ‘মায়াদর্পণ’, ‘স্বর্গসিঁড়ি’, ‘শেষ রায়’, ‘বংশধর’, ‘ঝিনুকে সেই তারা’ উপন্যাসগুলো অসামান্য লাগলো। লেখাগুলোর অনন্য বৈশিষ্ট্য বোধহয়, একটা চরিত্রকে কেন্দ্র করেই গল্প টেনে যাওয়া। লেখার ধাঁচটা অপূর্ব লাগে তার। একটু জীবন, একটু স্বপ্ন, একটু অনুভূতি, একটু দর্শন- সবকিছু মিলিয়ে অনন্যসাধারণ লেখনী। নামের মতই, পাঠকের, ‘আশা-পূর্ণা’!

আর মুভির লিস্টে দেখলাম অবলিভিয়ন। সাই-ফাই মুভিগুলো মোটামুটি ধাঁচের লাগলেও এই মুভিটা দারুণ লেগেছে। গল্পের টার্নগুলো চমৎকার, বিস্ময়জাগানিয়া।  ভিক্টোরিয়ায় চরিত্ররূপায়নটা চমৎকার, অভিনেত্রীর অভিনয়টা হৃদয়ছোঁয়া। এরপর বোধহয় অপর্ণা সেনের ‘ন হন্যতে’ কিংবা ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দহন’ দেখবো। ঠিক নেই। খুঁজে পেলে অন্য কোনো মুভিও দেখা হতে পারে। দেখা যাক!

-মুহূর্ত-

বলা হয়ে থাকে, পড়াশোনার উৎকৃষ্ট মুহূর্ত প্রভাত। লিখবার উৎকৃষ্ট মুহূর্ত কখন, কাঠপুতুল? বোধহয় শেষরাত্রি কিংবা নিদেনপক্ষে মধ্যরাত। লেখাটার মাঝের অংশটা দিয়ে শুরু করেছিলাম কাল সন্ধ্যায়। কিন্তু অনুভূতিগুলোকে সাজিয়ে দিতে পারলাম না। ফেলে রাখলাম। রাতজাগা হয়নি কাল, অত্যধিক ক্লান্তিতে। আজ সারাদিন ঘুমিয়ে দিনলিপির সমাপ্তি টানলাম।

শুভ রাত্রি!

মাঝরাত্রির প্রশ্ন


-অন্তর্জাল-

ক’দিন থেকেই ভাবছিলাম ব্লগটা প্রাইভেট করে দেবো। প্রথমত, না লিখে মনকে হালকাও করতে পারব না; দ্বিতীয়ত, দিনলিপিগুলো বড্ড বেশি ব্যক্তিগত অনুভূতিতে পূর্ণ। পাঠককে কি খানিকটা অস্বস্তিতে ফেলে দেয় কি না, জানি না। আবার, আমি যেহেতু কারো জন্যে, স্পষ্ট করে বলতে গেলে, কারো পড়বার জন্যে লিখি না, সেক্ষেত্রে ব্লগটা প্রাইভেট করে দেয়াই বোধহয় সমীচীন।

খানিক দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই তাই অন্তর্জাল ঘাঁটলাম। আমার মত ব্যক্তিগত অনুভূতি নিয়ে আর কেউ লিখছেন কি না। পেলাম বেশ কয়েকটা ব্লগ। এবং খানিকটা স্বস্তি পেলাম এই ভেবে যে, নাহ, আরো ক’জন লিখছেন।

তবুও আমার দ্বিধা কাটেনি এখনও। ব্লগের যে দু চারজন পাঠককে আমি জানি, তাদের চোখে যদি এ লেখাটি পড়ে, তারা কি আমাকে জানাবেন যে লেখাগুলো আপনার অস্বস্তির কারণ হচ্ছে কি না? আমি এতটাই naïve যে এটুকুও বুঝতে অক্ষম।

তবে অন্তর্জালের সাথে আমার আপাতত কাঠপুতুলের জন্যেই থেকে যাওয়া। ফেসবুক বন্ধ করে দিয়েছি আজ প্রায় আটদিন হল। একটু অদ্ভুত লাগলেও আমার কিন্তু মোটেও কোনো কিছুর অনুপস্থিতিবোধ হচ্ছে না। বরং খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছি। কেন যেন মনে হয়, ফেসবুক মানুষের মনকে লুপ্ত করে দেয়। তার অনুভূতিগুলোকে লুপ্ত করে দেয়। বহুদিন পর ফেসবুকে ঢুকে অন্যদের পোস্টগুলো দেখলে মনে হয় সব মানুষই কেমন যেন অন্যের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে আছে, সবকিছু নিয়েই তাদের বিরক্তি। সেই বিরক্তির ছায়া কি বাস্তব জীবনেও খানিকটা পড়ে না? পড়ে।

যদিও আমার সমস্যা অন্য বিষয়ে। তবুও যথাসম্ভব স্থিরচিত্ত থাকতে চাইছি। ছায়াজীবনের চেয়ে বাস্তব বিষণ্ণতার জীবন ভালো। প্রিয় মানুষগুলো তো আছেই পাশে।

অন্তর্জালের মানুষেরা কি সত্যিই কখনও আমাদের সত্যিকার আপন হয়ে উঠতে পারে? বোধহয় না। আমরা কৃত্রিম এক মায়া সৃষ্টি করি, কৃত্রিম এক আন্তরিকতার মায়াজাল সৃষ্টি করি। যে কারণেই প্রয়োজনের সময় আমরা আর কাউকে খুঁজে পাই না। কৃত্রিম অনুভূতি দিয়ে কারো পাশে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। যদিও আমার সবচে কাছের বন্ধুটিকে আমি পেয়েছিলাম অন্তর্জালের মাধ্যমেই। এখন অবশ্য তার বাস্তবেই বসবাস।

বানানটা কি অন্তর্জাল হবে না আন্তর্জাল? একসময় এটা নিয়েই বিপুল তর্কবহুল এক লেখা দেখেছিলাম। ঠিক মনে পড়ছে না। যার যেটা মনে হয়, ধরে নিন।

-দোসর-

সিনেমা দেখছি সময় কাটাতে, আগেই বলেছিলাম। কাল দেখছিলাম ঋতুপর্ণ ঘোষের ‘দোসর’। শীর্ষেন্দুর গল্প অবলম্বনে। যদিও জানি না, ঠিক কোন গল্পটা অবলম্বনে সিনেমাটা বানানো। খুঁজেটুজে কিছু পেলাম না। অনেকগুলো সিনই স্কিপ করে যেতে হয়েছে, বয়সের উপযোগী না হওয়ায়। আমার এক্ষেত্রে বেশ অভক্তি। প্রেম জিনিসটা নেহাৎ ব্যক্তিগতই থাকা উচিত, সেটা প্রকাশ্য হলেই তার মাধুর্য হারায়। বয়স বাড়লে এ ধারণার পরিবর্তন হবে কি না, কে জানে!

তবে সিনেমা থেকে একটা বার্তা আবিষ্কার করলাম, (দর্শকভেদে বার্তাটুকু ভিন্ন হওয়াই স্বাভাবিক)। প্রিয় মানুষগুলোর ভুলগুলো যেমন মেনে নেওয়া কঠিন, তেমনি তাদের ক্ষমা করে দেওয়াও জলের মত সহজ। মেয়েদের মন হয়ত নরম বলে তার কিছু প্রতিশোধ নিতেও তাদের আটকায় না। তবে প্রতিশোধের পরবর্তীকালীন সময়টাতেই সেসব ভুল কিংবা প্রতিশোধের চিহ্নটুকুও খুঁজে পাওয়া যায় না। সেজন্যেই হয়ত প্রতিশোধটুকু নিতে দেয়া উচিত! লোহাকে শুদ্ধ করবার প্রক্রিয়াটার মত!

তবে গল্পটা চমৎকার ছিল। একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করেই সিনেমাটার এগিয়ে যাওয়া। প্রায়ই এই ধাঁচের গল্প পড়ি, আর বুঝে উঠতে পারি না, একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এতখানি লিখে ফেলা সম্ভব। এ কারণেই হয়ত আমি গল্প লিখতে পারি না। লেখার কৌশলটুকু জানি না বলে। তবে ব্লগ স্ট্যাটস ঘেঁটে দেখলাম আমার ‘ব্যবধানের গল্প’টা বেশ ক’বার পড়া হয়েছে গত ক’দিন। কে বা কারা এইসব ছাইপাশ পড়ছে জানা নেই। আজকাল গল্পলেখকের কোনো শেষ নেই। আর চমৎকার সব গল্প তাদের। দু একটা বাদে বেশিরভাগই পড়তে মন্দ নয়।

সিনেমাটায় একটা কবিতা পেলাম। সুজাতা গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা হতে পারে, কিংবা হয়ত আবৃত্তিটা তার করা। তার থেকে চারটে লাইন মন কাড়লো।

“যেমন সব ভয়ের গল্পে-
দৈত্য দানো-রাক্ষস আর ক্ষয়,
তিলে তিলে শুকোয় রাজকুমারী
অন্তঃমিলে রাজপুত্রের জয়”।

কখনও কি কোনো রূপকথার গল্পে দেখেছেন সবশেষে রাজপুত্রের পরাজয়? আমি দেখিনি। অবশ্য সেই গল্পটা ভিন্ন ছিল। ঐ যে, দুই বাড়ির মধ্যে রেষারেষি। কিন্তু ছেলে-মেয়েদুটিতে ভারি প্রেম। দু’বাড়ির দেয়ালের ছিদ্র দিয়ে কথা বলত তারা। শেষে দেখা করতে গিয়ে মেয়েটি দেখলো ছেলেটি তখনও আসেনি। হঠাৎ এক সিংহের আক্রমণে মেয়েটি দিকবিদিক দৌড়ে পালালো। আর তার ফেলে যাওয়া ওড়নায় লেগে গেল সিংহের সদ্য খেয়ে আসা প্রাণীর রক্ত। মেয়েটি লুকিয়ে রইল বহুক্ষণ।  ছেলেটি এসে সেই রক্তমাখা কাপড় দেখে ভাবলো মেয়েটি মারা গেছে। সে শোকে নিজেও আত্মহত্যা করল।  তখন মেয়েটা বেরিয়ে এসে ছেলেটির মৃতদেহ দেখে নিজেকে দায়ী করে নিজেও আত্মহত্যা করলো ছেলেটিরই ছুরি দিয়ে। বিয়োগান্তক পরিসমাপ্তি।

এ ধরণেরই একটা গল্প। বহুদিন আগে পড়েছি। মাসখানেক আগে বাচ্চাকালের কিছু বইপত্র এক লাইব্রেরিতে দিয়ে দিয়েছি পরী মারফত। রাখার জায়গা হচ্ছিল না আর।

সব গল্পই কি এমন সুন্দর পরিসমাপ্তি সম্ভব? অন্তঃমিলে রাজপুত্রের জয়? তাই হোক। আমার বেলাতেও তাই হোক। এত দুর্বল হয়ে গেছি, চাইলেও আর শক্ত হয়ে দাঁড়াতে পারবো না।

 

খামবন্দি অনুভূতি : হৃদয়-সত্য


প্রিয় রোদ্দুর,

মন বোধহয় মাঝেমধ্যে মানুষের অজান্তেই আপন অনুভূতিগুলোকে উৎসারিত করে দেয়। মানুষটিকে না জানিয়েই। যেমন আমি এই মাঝরাত্তিরে গুনগুন করে গেয়ে উঠলাম, “হারাই হারাই সদা ভয় হয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে…”। মন যে জানে, আমি যে হারাবার ভীষণ ভয়ে আছি!

সচরাচর আমি বিধাতামুখী নই। স্বার্থবাদী। বিশ্বাস করি না তা নয়। করি। কিন্তু নেহাৎ দায়ে পড়লেই বিধাতার মুখাপেক্ষী হই। এ নিয়ে নিজেকে যে মাঝেমধ্যে দোষ দিই না, নিজেকে ধিক্কার দিই না, তাও নয়। দিই। ভালোভাবেই দিই। কিন্তু এই যে মন, কিছুতেই মানতে চায় না। নিজেকে স্বর্গমর্ত্যের অধীশ্বর ভাবতে ভালোবাসে। তবুও মাঝেমধ্যে সেও পরাভূত। কিছু না পাবার সম্ভাবনা থাকলে অনায়াসেই নির্লজ্জের মত নেমে আসে ধূলির পৃথিবীতে। মাথা নত করে বিধাতার কাছে। আজও করবে। বোধহয় করতে শুরু করবে চিরদিনের মত।

মনকে কিছুতেই সুস্থির করা যাচ্ছে না। একবার সে ভাবছে, প্রচণ্ড খেটেখুটে ভালো কোথাও এ্যাডমিশন নেবে; কখনও ভাবছে, আর সবার মতই এক্সামের পরেই খাটাখাটনি শুরু করবে; কখনও ভাবছে, ‘ধীরে এগোও বৎস’। সব মিলিয়ে কিছু না করবার সেই পুরনো অবস্থাতেই আছি।

আশাপূর্ণা দেবীর উপন্যাসসমগ্র পড়বার সময় বের করতে পেরেছি অবশ্য। দিনের বেশিরভাগ সময়টাই তো কাটাই বিছানায়। আধো ঘুমে কিংবা নিদ্রাদেবীর উষ্ণ আমন্ত্রণে তার রাজ্যে। হয়ত বইটা হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি। একটা লাইন বেশ ভালো লাগল,

“-সোজা কথা হচ্ছে, সমাজের মুখ চাইতে হবে, আইনের দায় মানতে হবে।

-তা বটে! শুধু চাইতে হবে না মানুষের মুখ, মানতে হবে না হৃদয় সত্যের দায়!”

আরও পড়ো,

“শুধু বুঝতে পারত না, হৃদয় সত্যের দায়  পোহানোর ঝক্কি কতখানি। বুঝতে পারত না, সবাইয়ের সাধ্য নেই সেই ঝক্কি সামলাবার। সাধ্য নেই, তাই মানুষ সত্য আর মিথ্যা, খাঁটি আর ভেজাল, হৃদয়-দ্বন্দ্ব আর সমাজ দ্বন্দ্ব সবকিছুকে লোকচক্ষু নামক পাকযন্ত্রে চড়িয়ে একটা পাঁচন তৈরি করে করে গিলে জীবন-জ্বরের শান্তি খোঁজে”।

‘জহুরী’ উপন্যাস থেকে তুলে দিলাম লাইনগুলো। বেশ, না? অকাট্য সত্য।  আমি কতবার কেবল সমাজের চোখে হেয় হবো ভেবে কত হৃদয়-সত্যকে ছাইচাপা দিয়ে এগিয়ে গেছি সামনের পথে, তার হিসেব নেই। সেদিন একজন আমাকে বলল, আমি মানুষের কথায় খুব বেশি কান দিই। খুব বেশি মূল্য দিই। সত্য। অস্বীকার করবার কিছু নেই। আমি নেহাৎই দুর্বল, ভীত এক বালিকা। যে কি না, অনায়াসে চাপা দিতে পারি হৃদয়-সত্য; মুখে হাসি আর হৃদয়ে ছাইচাপা বাসনার অবশেষ নিয়ে হেঁটে যেতে পারি বহুদূর, বহুদূর। কেবলই লোকচক্ষুর ভয়ে।

কে জানে! কে জানে!

তবে বিধাতামুখী হচ্ছি, এটা নিশ্চিত। আমার যে আজকাল খুব ভয় করে। ভবিষ্যত নিয়ে ভীষণ ভয় করে। মানুষজনের আশা-আকাঙ্ক্ষায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছি দিন দিন। নিজের ইচ্ছা-আকাঙ্ক্ষা-বাসনা বলতে কিছুই নেই। খুব সহজে আহত হই বলে তর্কও চালিয়ে যেতে পারি না। অপরপাশের মানুষটি মনে করে মেনে নিচ্ছি। সবশেষে তো মেনেই নিই।

ভেবেছিলাম জীবনে কখনও মেডিকেল প্রফেশনের দিকে যাবো না। কখনও আগ্রহ বোধ করিনি। শৈশবে ভাবতাম শিক্ষক হবো। বাবাও বলতেন, ভালো। দ্বিমত করতেন না। সময় পেরোবার সাথে সাথে জানলাম, তার আমাকে মেডিকেলে পড়াবার খুব শখ। বাবার সাথে প্রায় সংঘর্ষ বাঁধবার উপক্রম। তা অবশ্য প্রায় সময়েই বাঁধে। সেসব নিয়ে তেমন ভাবিতও হই না, যদিও প্রথমে ভেঙে পড়ি খুব। অথচ এখন দ্যাখো, ভাবছি কি না বুয়েটের আশা ছেড়ে মেডিকেলেই ঢুকবো। এ্যাডমিশনের প্রসেসটাও সহজ, বুয়েটের চেয়ে। আমি অতটা মেধাবীও নই কি না। এরচে সাফল্যের সংক্ষিপ্ততম পথটুকুই ধরা যাক। দুর্নামও হবে না। ভবিষ্যতটুকুও মসৃণ।

দেখেছো, এখানেও কিন্তু আমি সমাজের কথাই ভাবছি। লোকচক্ষুর কথাই ভাবছি। দুর্বল, দুর্বল এবং দুর্বল।

একবার এমনই এক দিনে, বসন্তের শুরুতে পরী বলেছিল, যা মন চায়, করে ফেলবি। থেমে থাকবি না। জীবনের আনন্দটুকু পাবি না তাহলে। সময় পেরোবার সাথে সাথে সেও বাবার মত বলে বসলো, আমাকে তার ডাক্তার হিসেবেই পছন্দ। বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম, বাকিরাও তাই ভাবছে। সহপাঠিনীরাও। ক্ষুব্ধ হলাম। বিষণ্ণ হলাম। কারোরই মন টললো না। কেউই ভেবে দেখলো না যে আমার তো সৃষ্টির নেশা। আমার কি ভালো লাগে, কেউই তলিয়ে দেখতে যাচ্ছে না। সময়ও খুব বেশি বাকি নেই। কেউ ভেবেও দেখবে না।

রোদ্দুর, শেষমেষ কি জীবনটা আমার থাকছে? নাকি স্রেফ অন্যদের জন্যে জীবনটাকে টুকরো টুকরো করে বিলিয়ে দিচ্ছি? যে এসে হাত পাতছে, অনায়াসে তাকে দিয়ে দিচ্ছি জীবনের একটুকরো। কোনো বাছাই ছাড়াই। উপযুক্ত-অনুপযুক্ততার কথাও ভাবছি না। স্রেফ, দিয়ে দিচ্ছি। কেন? লোকচক্ষুতে ভালো হবার জন্যে।

হ্যা, এ আমার সরল স্বীকারোক্তি। জীবনে প্রত্যেকটা কাজ করবার আগে শতবার ভেবে নিয়েছি, সমাজ কী বলবে। বাবা-মার লক্ষী মেয়েটি হয়ে থাকতে চেয়েছি। জীবনটাকে নিখুঁত রাখতে চেয়েছি প্রায়। রেজাল্ট খারাপ হলেও মা বলত আগে, ‘এখন ভেবে দ্যাখো, মানুষ কী ভাবছে?’ সেখানেও মানুষ। তথা সমাজ। এখন অবশ্য মা’র বলার ধরণটা বদলেছে। তাও তো প্রায় দশ বছর পেরিয়ে। নিজ থেকে বদলায়নি। বিধাতার ইশারাতেই বদলেছে।

রোদ্দুর, আমার যে খুব পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করে সবকিছু ছেড়ে। যেখানে গিয়ে বুঝতে পারব জীবন কাকে বলে। জীবনে অপ্রাপ্তি কাকে বলে। স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকা কাকে বলে। আমার এত নিখুঁত জীবনের যে প্রয়োজন নেই। স্রেফ নিজের ইচ্ছেমত বেঁচে থাকাটুকু শিখতে চাই। বিদ্রোহ করা শিখতে চাই। শিখতে চাই কিভাবে ‘না’ বলতে হয়।

ঘুরে ফিরে আবারও ডিসেম্বর। আর ২২ দিন বাকি, আমার পুনর্জন্মবার্ষিকীর। হাসি পাচ্ছে পড়তে, তাই না? সেভাবে করে পালন করবার কিছু নেই। পালন করতে পারতাম, যদি ফিরে এসে বুঝতে পারতাম জীবনের মর্মার্থ। যদি বুঝতে পারতাম, আমার নিজের মত করে, নিজের ইচ্ছেগুলোর উপর ভর করে বেঁচে থাকবার ইশারা আবার এই ফিরে আসা। কিচ্ছু বদলে যায়নি। নতুন করে বেঁচে উঠেও আমি স্রেফ লোকচক্ষুর ভয়েই নত আছি, নত আছি অন্যের আকাঙ্ক্ষা পূরণে।  সেসময়কার কিছু চিঠিপত্র হাতে পেয়েছি পরী মারফত। একটা চিঠির এক জায়গায় লেখা, আমার মৃত্যুসংবাদ কোনো একজনকে বিচলিত করবার পরিবর্তে বিরক্ত করেছে।

বলা বাহুল্য, আমি যেন নিজের ভবিষ্যতটুকু দেখতে পেলাম সে বাক্যবিন্যাসে। সত্যিই, সবকিছু বিলিয়ে দিয়েও কি আমি কারো অনুভবের যোগ্য হতে পেরেছি? কিংবা পারব? প্রশ্ন উঠতে পারে, আমি কতখানি বিলিয়ে দিয়েছি।  উত্তরে এটুকুই বলতে পারি, নিজের হাতে রাখিনি কিছুই। স্বাধীনতাটুকুও নয়। সবকিছুই অন্যের হাতে। তাও সেই ‘অন্য’ কোনো একজন নয়। একাধিক। ফলস্বরূপ, গ্রহীতার দৃষ্টিতে আমি কিছুই দিতে পারি নি। আর আমার দৃষ্টিতে, বিলিয়েছি সর্বস্ব।

আজ এটুকুই থাক। চিঠিটা দীর্ঘ হলেও মন শান্ত হয়েছে বোধ করি। বিধাতামুখী হবার সময় হয়ে এলো।

ইতি,

কাঠপুতুল

অষ্টাদশীর প্রলাপ


-দিনকাল-

নিতান্তই অলস সময় কাটছে। কিছুই করতে পারছি না। সোজা বাংলায়, ভালো লাগছে না। কোথাও যেতে পারলে হয়ত খানিকটা অবসাদ কাটিয়ে উঠতে পারতাম। উপায় নেই। অতএব ঘরবন্দি হয়েই বইয়ে মুখ গুঁজে স্বপ্ন দ্যাখো। তবে প্রচণ্ড ঘুম পায় আজকাল। একটু এলিয়ে পড়লেই ঘুমিয়ে যাচ্ছি। আর ঘুমের সাথে সাথেই স্বপ্নে ডুব। অদ্ভুতুড়ে সব স্বপ্ন। রাতে তিনটায় ঘুমিয়ে বেলা বারোটায় উঠলাম। আবার চারটায় ঘুমিয়ে ছ’টায় উঠলাম। তারপর আবার আটটায় ঘুমিয়ে সাড়ে এগারোটা। এভাবে কেবল ঘুমিয়েই যাচ্ছি। আর একের পর এক অদ্ভুতুড়ে স্বপ্ন দেখছি।

যেমন দেখলাম, পালিয়ে যাবার জন্যে কাঁদছি। আমার এই বাড়িটা আর ভালো লাগছে না। তাই কেঁদে কেঁদে সবাইকে অনুরোধ করছি আমাকে যেতে দিতে।

তবে এটা কি সত্যিই আমার মনের ইচ্ছে নয়? বলা হয়ে থাকে, মনের একান্ত ইচ্ছেগুলো স্বপ্নে প্রকাশ পায়। না, বাড়িটা আমার ভালো লাগছে বটে, তবে আমি তো চাইছিই। জীবন থেকেই পালাতে চাইছি। জীবনের রূঢ় বাস্তবতা থেকে পালাতে চাইছি। বহুদূর। বহুদূর। যেখান থেকে আর খুঁজে পাবে না কেউ। কেবল নৈঃশব্দ।

-বোধ-

‘নৌকাডুবি’ দেখছিলাম। পড়া ছিল না আগে। অতটা মনোযোগ দিয়ে বোধহয় দেখিও না, তাই প্রথম দিকেই ভুলটা বুঝতে পারিনি। বুঝতে পারলাম অনেক দেরিতে। তেমন দ্রুত মস্তিষ্কের নই তো।

জীবনে কতশত ভুল বুঝতে পারলাম অনেক দেরিতে। এখনও হয়ত কিছু ভুল আবিষ্কারের অপেক্ষায়। এত এত ভুল, সবকিছুর লিস্ট করে রাখা দরকার হয়ত। নাম দেব, ‘নির্বুদ্ধিতার ফর্দ’। বয়স বাড়লে পাতা উলটে দেখবো ভুলের তালিকা কতখানি লম্বা হল।

-স্বার্থ-

“আর যারা ভালোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়”

-বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি/পূর্ণেন্দু পত্রী

হয়ত তাই। যারা ভালোবাসে, তারা আপন আত্মার অশ্রুভারে সিক্ত হয় প্রতিনিয়ত। আকাঙ্ক্ষার অপূর্ণতায়, চেয়ে না পাবার বিষাদে, হতাশায়, একাকীত্বের কুয়াশায়, কিছুই-ভা্লো-না-লাগার ক্ষণে প্রত্যাশিত কারো সঙ্গ না পেয়ে; সবকিছুই কি হৃদয়কে প্রবলভাবে আহত করে না? আমাকে করে। ভীষণভাবে করে। আমি যে দুর্বল হৃদয়ের অধিকারিণী। আমাকে আহত করা সহজ। কিংবা সহজতম।

এমন হৃদয়ের চিকিৎসা হওয়া উচিত আজীবন নির্বাসন। বন্ধুত্ব নেই, মায়া নেই, ভালোবাসা নেই, প্রত্যাশা নেই; এমন সেই হৃদয়কে চিরদিনের জন্যে কৃষ্ণবর্ণের চাদরে মুড়ে দেয়া উচিত। পৃথিবীটা নেহাৎই কঠিন। এত কিছু চাইতে গেলে শূন্য হাতে বিষাদফোঁটার পতনই অনিবার্য।

তবুও কেন যেন খুব চাইতে ইচ্ছে করে। ঘণ্টা দুয়েক, কিংবা তার সাথে আরো শ বিশেক মিনিট যোগ কিংবা সারা রাত্রি। হতে পারে ভোরের কুয়াশা কাটবার সময়টুকু। সম্পর্কটা হতে পারে মায়া কিংবা নেহাৎই বন্ধুত্বের। শুধুমাত্র স্বার্থের অনুপস্থিতিটুকুই চাইছি।

কিন্তু হায়, স্বার্থ বিনে কি কেউ আমরা আঙুলটুকুও নাড়াই? সময় ধার দেয়া তো দূর!

-অন্তর্মুখিতা-

তবে আমার কিন্তু এই অন্তর্মুখিতার জীবন বেশ লাগছে। বুঝতে পারছি, আমি নেহাৎই পৃথিবীতে বাহুল্য মাত্র। আমার উপস্থিতি-অনুপস্থিতি কাউকে ভাবিত করবে না বিন্দুমাত্রও। বরঞ্চ অনুপস্থিতিই সবাইকে স্বস্তি দেবে। কার দায় পড়েছে অষ্টাদশী বালিকার প্রলাপ শুনবার।  কাঠপুতুলেও বোধহয় মানুষের আনাগোনা কমতে শুরু করেছে। কারো সাড়া পাই না এখানে যে আজকাল। সেই ভালো। সেই ভালো। আমি চাই আমার বিষাদপ্রলাপগুলো কেবল অস্তিত্বহীন কারো হৃদয়েই নাড়া দিক। পার্থিব জগতের কারো মূল্যবান সময়টুকু কেড়ে নিতে চাইলেও যে পারব না, জানি। অতএব ভেবে নিতে শিখছি, নিজের দায়টুকু নিজের কাছেই। কারো দায় পড়েনি অন্যের বিষাদপ্রলাপ শুনবার। আমার বেলায় তো না-ই। সবচে প্রিয় মানুষটিও সে দায় নেবে না, জানি। আর কারো কি নেয়? জানা নেই। আমার যে নিচ্ছে না। আমার যে আর উপায়ান্তর নেই। কাঠপুতুলকে শোনানো ছাড়া।

“বিষাদ ছুঁয়েছে আজ, মন ভালো নেই,
মন ভালো নেই;
ফাঁকা রাস্তা, শূন্য বারান্দা
সারাদিন ডাকি সাড়া নেই,
একবার ফিরেও চায় না কেউ
পথ ভুল করে চলে যায়, এদিকে আসে না
আমি কি সহস্র সহস্র বর্ষ এভাবে
তাকিয়ে থাকবো শূন্যতার দিকে?
এই শূন্য ঘরে, এই নির্বাসনে
কতোকাল, আর কতোকাল!”

-মন ভালো নেই/মহাদেব সাহা

খামবন্দি অনুভূতি: প্রশ্নটুকু বিশ্বাসের


প্রিয় রোদ্দুর,

অনেকদিন দেখা নেই তোমার। শীতের কুয়াশার উপস্থিতিতে নিজের স্বকীয়তা হারিয়েছো বুঝেছি। অতীব উজ্জ্বল কারো উপস্থিতিতে নিজের স্বকীয়তা হারানোই স্বাভাবিক। যদি অতখানি শক্তিশালী না হও, তবে স্বকীয়তা না হারানোটাই অস্বাভাবিক। প্রকৃতির এই অদ্ভুত এক নিয়ম। একে অন্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত, টিকে থাকার আদিম যুদ্ধে। নিষ্ঠুর এক যুদ্ধে। কারো মাঝে এতটুকু মায়া জন্মায় না, অন্যের জন্যে স্থান ছেড়ে দিয়ে নিজে লুপ্ত হয়ে যাবার ইচ্ছে জন্মায় না। একে ইচ্ছে বলব, না, সাহস বলব? আমরা কেউই জানি না, অস্তিত্বহীনতার অনুভূতি। কিংবা জানি না, প্রাণহীনতার জগতে আমাদের বিচরণ কতখানি সুখকর। কেউই হয়ত তার মুখোমুখি হতে চাই না। অতখানি আমাদের সাহস হয় না। এবং নিজেদের সাহসহীনতার স্বীকারেও আমাদের দ্বিধা নেই। তাই নিঃশব্দ, নির্লিপ্ত যুদ্ধে নিজেদের বীরত্ব জানান দিয়ে যাই। অদ্ভুত এক বীরত্ব।

টিফানি আলভোর্ডের গানগুলো শুনছি। প্রথম দিকে ওয়ান রিপাবলিকের সিক্রেটস গানটার কাভার এত ভালো না লাগলেও মেয়েটা গানগুলোকে নতুনভাবে সাজিয়েছে। আবিষ্কারের অনুভূতি অন্যরকম। কোনো কিছুকে ভেঙেচুরে নিজের মত করে নেবার আনন্দ হয়ত অন্যরকম। আমার জানা নেই। আমি পারিনি কোনোদিন। বরাবরই আমি দুর্বল এবং ভঙ্গুর। অনুজ্জ্বল। টিকে থাকার লড়াইয়ে পরাহত। আমাকেই ভেঙেচুরে নিয়েছে সবাই। তুমিও। আমি কাউকে ভাঙতে কিংবা গড়তে পারিনি। পারব না কখনও। অতখানি শক্তি আমার নেই। নেই সাহস।

না থাকুক। কারো স্বকীয়তাকে আমি ভাঙতে চাই না। তবে অজান্তে ভেঙে থাকলে সেজন্যে আগেই ক্ষমাপ্রার্থী। হয়ত ভুলে আমার চেয়ে দুর্বল সে। হতেই পারে।

এমন করেই তো নিজেদের ভুলগুলো আমরা কোনো না কোনো কারণ দেখিয়ে এড়িয়ে যাই। টিকে থাকতে হবে বলেই। ভুল স্বীকারে আমাদের ভীষণ অনীহা। আমার নেই।

অন্তর্জাল সম্পর্কে আমার ভীষণ অভক্তি চলে এসেছে। অভক্তি এসে পড়েছে বড়দের নিয়েও। বড়দের জগতটা ভীষণ ক্রূঢ়। খুব কুটিল এবং জটিল। ফেসবুক বন্ধ করে দিলাম কাল রাতে। সবাইকে সরিয়ে দিতে পারব না। অতখানি নিষ্ঠুর আমি নই। এরচে নিজের স্থানটুকু ছেড়ে দেয়া সহজ। এবং সরলতম সমাধান। কাউকেই ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। কেউই বিশ্বাসের উপযুক্ত নয়। এরচে অন্তর্মুখিতার জগতে ডুব দেয়া ভালো। যদি কখনও অতখানি জটিলতায় নিজেকে অভ্যস্ত এবং নিঃসীম জটিলতায় নিজের মনকে আবদ্ধ করতে পারি, তবে ফিরবো। নিজেকে খানিকটা গুছিয়ে নিই। টিকে থাকবার জন্যে প্রস্তুত করে নিই।

যদিও জানি, আমার প্রস্তুতি শেষ হবে না কখনও। মুখে বাক্যবাণ ছুঁড়তে পারলেও মনে কখনই কাউকে আহত করবার ইচ্ছে রাখিনি। পরবর্তীতে সেইসব বাক্যবাণ ছুঁড়বার অনুতাপটুকু কেউ কখনও দেখতে পায় না। ভেবে নেয়, আমি এমনই। আমিও আর কাউকে বোঝাতে চেষ্টা করি না। আগেই তো বলেছি, প্রকাশক্ষমতা হারাচ্ছি।

অতএব কাঠপুতুলই একমাত্র সহায়। তাকে বোঝাবার দায় নেই। সে বুঝে নেয় সবই। কি ভীষণভাবে অন্তর্মুখী হয়ে যাচ্ছি দ্যাখো।

পড়াশুনো গুছিয়ে নেওয়া দরকার। টেস্ট পেপার কবে বেরোবে, জানি না। ততদিন নিজেকে ব্যস্ততায় আবদ্ধ করতেও মন চাইছে না। হয়ত ভবিষ্যত কোনো ফলাফল সংক্রান্ত দুর্ঘটনার জন্যে এই ইচ্ছেকেই দায়ী করব, সেই ভেবে দুশ্চিন্তারও অন্ত নেই। কী করব, ভেবে পাচ্ছি না। হাতে উপন্যাস আছে ২২টার মত। পড়বার মত ধৈর্যও পাই না। স্রেফ কিছুই ভালো লাগছে না। বড়দের জটিলতায় ক্লান্ত। তারচে বেশি হতাশ সেই জটিলতায় আমাকে ব্যবহার করা নিয়ে। প্রশ্ন এটুকুই, কাকে বিশ্বাস করব, আর করবনা, তার সূত্র কী? এ প্লাস বি হোল স্কয়ারের মতো কোনো সূত্র নেই, যার ছাঁচে ফেলে না মিললে বুঝতে পারব, সে বিশ্বাসের অযোগ্য?

জীবন নিয়ে আমি কী ভীষণভাবে মূর্খ, দেখেছো রোদ্দুর? ভাবছি কি না, দুটো সূত্র প্রয়োগ করেই মানুষ চিনতে পারব? সমবয়সীদের কাছে এত বেশিবার পোড় খেয়েছি যে এখন তাদের বুঝতেও ইচ্ছে করে না। ইচ্ছে করে না তাদের দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়াই। তৃতীয়বার, এই নিয়ে তৃতীয়বার বড়দের জটিলতায় আটকে গেলাম। কি বিচ্ছিরি একটা অনুভূতি। নিজেকেই দোষী মনে হচ্ছে। হয়ত এটাই সত্যি যে, আমিই আমাকে অন্যের হাতের ঘুঁটি হতে দিই। তারা কর্মসম্পাদন শেষে পালায়। আমি তাদের দোষী ভাবি। কিন্তু দোষ তো আমারই। আমার নির্বুদ্ধিতার। আমার বোকামির। আমার অনাকাঙ্ক্ষিত সারল্যের। আমার সহজে আহত হবার প্রবণতার। যদিও আমি এর সাথে সম্পৃক্ত মানুষগুলোর ব্যাপারে একটুও ভাবিত নই। আমার স্রেফ মনে এতটুকুই প্রশ্ন জাগছে, তবে আমি কাকে বিশ্বাস করব?

গ’কে কাল জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে কেমন মনে হয় তার। কুটিল? জটিল? সবচে খারাপ? তার উত্তর, আমি অনেক বেশি সরল। আমি কিভাবে কুটিল হতে পারব, লিখে পাঠিও রোদ্দুর। টিকে থাকতে হবে। আমারও যে খুব আঁধারে ভয়।

হয়ত এখন অন্তর্জাল মানে কেবল তোমাকে চিঠি লেখা আর কাঠপুতুলের সাথে আলাপচারিতায় সীমাবদ্ধ থাকবে। আমার আর কাউকেই বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করছে না। কেউ বিশ্বাসের উপযুক্ত নয়। প্রত্যেকের মাঝে স্বার্থ নিহিত। আমার মাঝে স্বার্থ খুঁজবার কিছু নেই যদিও, তবুও তারা কিভাবে স্বার্থ খুঁজে পায়, জানি না। আর কারো হাতের পুতুল হতে দেবো না নিজেকে। বিধাতার হাতের পুতুল তো হয়েই আছি জন্মাবধি। সবটুকু মায়া-বিশ্বাস-সহানুভূতি বিসর্জন দিলাম।

এ গানটা অনেকদিন পরে শুনছি। প্রিয় গান ছিল একসময়। যদিও চিঠির সাথে এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। তবুও শোনো। হয়ত এতসব বিরক্তিকর কথার মাঝখানে তোমার মন ভালো করে দিতেও পারে।

“Close my eyes tightly, hold on and hope that I’m dreaming
Come wake me up”

সত্যিই সবকিছুকে ইচ্ছে করে ঘুমের মাঝে দুঃস্বপ্ন ভেবে উড়িয়ে দিই। খুব ইচ্ছে করছে কেউ এসে বলুক, ‘কিচ্ছু হয়নি তো! স্বপ্ন দেখছিলে!’ এমনটা হবার নয়। আজ প্রায় সারাদিনই ঘুমালাম। এত ক্লান্তি জমে আছে, জানা ছিল না। স্বপ্নের এক পর্যায়ে দেখতে পেলাম, আমি আর হাঁটতে পারছি না। কোনো এক দুর্ঘটনায় পা হারিয়েছি। মানুষজন আমার জন্যে ক্রাচ আনতে ছুটে যাচ্ছে। তনুজা আপাকেও অদ্ভুতভাবে এই স্বপ্নে দেখলাম কেন যেন। জিজ্ঞেস করলাম, অপার কোথায়। বাচ্চাটা আমার মায়া কেড়েছিল সেবার। তনুজা আপা সহানুভূতি জানালেন। তারেক পাশে পাশে ছিল। আর কাউকে পেলাম না।

আজ এটুকুই থাক। ঠাণ্ডা লাগছে খুব। মনও শীতল, আবহাওয়াও শীতল। কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে যাচ্ছে জীবন। ক্ষুদ্র জীবনটুকু।

ইতি,
কাঠপুতুল

জীবন্মৃত


“নতজানু হয়ে কারো পদতলে বসি, ইচ্ছে করে
অকপটে সব কথা তার সাথে বলাবলি হোক।”
-পূর্ণেন্দু পত্রী / আত্মচরিত

সত্যিই তো,এ কি আমারই আত্মচরিত নয়? আমার কি এমনটা ইচ্ছে করে না? করে। প্রবলভাবে করে। কিন্তু কিছু যে করবার নেই। না পারছি বড়দের ছায়ায় হাঁটতে, আর সমবয়সীদের সাথে তো মিশতেই পারিনি কখনও। আমি ঠিক তাদের বুঝে উঠতে পারি না, তারাও আমাকে বুঝে উঠতে পারে না। অতএব বিচ্ছেদ।

কে জানে, বন্ধুত্ব বলতে কী বোঝায়? প্রায় উনিশে পা দিয়েও এখনও বুঝে উঠতে পারিনি এই দুটো যুক্তাক্ষরবিশিষ্ট তিন অক্ষরের শব্দের মানে। হয়ত, হয়ত কোনোদিনই বুঝে উঠতে পারব না। আমার আর অকপটে সবকিছু বলাও হয়ে উঠবে না।

তবে অরণ্যসখা আর কাঠপুতুল বেশ ভালো শ্রোতা। অরণ্যসখা তো নেহাৎই কাল্পনিক চরিত্র। ভবিষ্যতে কাউকে হয়ত এ নামে ডাকব। তবু নামটুকু ঘিরে স্বপ্নগুলো এতখানি বাস্তব, হয়ত তাকে কখনও কখনও বাস্তব কোনো অস্তিত্ব বলে মনে হয়। আর কাঠপুতুল তো আমিই। শৈশব থেকে নিজের সাথে নিজে কথা বলার অভ্যেস আছে। হ্যা, নিজের সাথে নিজের প্রবঞ্চনা করা চলে না। সেখানে অকপটেই কথা বলা হয়। এ-ই বোধহয় ভালো। বিরোধিতার সম্ভাবনা নেই। সম্ভাবনা নেই অনাকাঙ্ক্ষিত নিজের তুচ্ছতার আবিষ্কারের। কিংবা হঠাৎ আঘাতের।

আমি এত দুর্বল কেন, কাঠপুতুল? এত ভঙ্গুর কেন? এ্যাকসিডেন্টের সময় আমার মানসিক শক্তির প্রশংসা শুনেছি, যদিও ভেতরে ভেতরে জানতাম সেসব কেবলই সাহস বাড়াবার প্রচেষ্টা। আমি তো জানি, আমি দুর্বল, আমি ভঙ্গুর, আমি naïve. Naïve এর বাংলা প্রতিশব্দ জানা নেই। মুখোমুখি বসে কারো সাথে তর্ক করতে পারি না, নিয়ম ভেঙে স্কুলের জুতোর পরিবর্তে স্লিপার পরে যেতে পারিনি অন্যদের মত, কখনও কাউকে খুব রুক্ষ ভাষায় বকাঝকা করতে পারিনি, কখনও পারিনি হুট করে কিছু উদ্ভট কাজকর্ম করে বসতে, লাইন ভেঙে কলেজের ফি’র স্লিপ জমা দিতে পারিনি, মনিটরের বিপক্ষে কঠিনভাবে তর্ক করতে পারিনি। আমি কী পারি, কাঠপুতুল? আমি এত ভয়ার্ত কেন সবসময়?

সেদিন অদ্ভুত একটা কথা পড়লাম। বেঁচে থাকা। বেঁচে থাকার মানে কী? আমি কি বেঁচে আছি? এর পরিপূরক প্রশ্নই বলা চলে, আমি কি আমার জীবন নিয়ে সুখী কি না। আকাশ দেখতে না পারার পরাধীনতাটুকু বাদ দিয়ে আমি সুখী। ওটুকু স্বাধীনতা আমার নেই। কেউ দিতে পারেনি আজ পর্যন্ত। কেউ পারবেও না বোধহয়। তবে আজকাল মানুষজনের কথায় চমৎকার সব ভাবনা ঘিরে ধরছে। এটাও সঠিক যে হয়ত আকাশ দেখবার স্বাধীনতাটুকু থাকলে কাঠপুতুলের জন্যে আমার এতসব গল্প জমা থাকতো না। এতখানি বিষাদের অবকাশও আমি পেতাম না। পরিপূর্ণ সুখী মানুষ হতাম। দান্তের ভাষ্যমতে, “দুঃখ আমার হৃদয়ে সাহস আনে”- এ বাক্যটুকুও আমার প্রিয় হত না। হয়তবা এত মর্মার্থই আমি উপলব্ধি করে উঠতে পারতাম না কখনও।

“এই ডালে দুঃখ এসে বসেছিল কাল।
বসে বসে দেখে গেল পাতা ঝরা, শিশিরের ঝরা
দৃশ্যকে নিহত করে হেমন্তের বাবুগিরি চাল
ফিনফিনে আদ্দির ওড়াওড়ি”।

-এই ডালে/ পূর্ণেন্দু পত্রী

ইদানিং সময় কাটাতে সিনেমা দেখি। শেষ দেখলাম ‘শব্দ’ সিনেমাটা। অদ্ভুত তাৎপর্যময়। সত্যিই এই যে ফ্যানের ঘরঘর শব্দ, পাশের বিল্ডিং এ লোহা কাটার শব্দ, ডাইনিং রুমে বাবার চামচের শব্দ, কিংবা এইমাত্র ভাইব্রেশনে কেঁপে ওঠার ফোনের শব্দ- প্রতিটা শব্দেরই অন্যরকম এক মাধুর্য আছে। তবে কি না সেসব শব্দ শুনতে শুনতে কোনোদিন যদি ভাষা হারিয়ে ফেলি, সেটা কাঙ্ক্ষিত নয় মোটেই। সিনেমার আরেকটা উক্তি বেশ ভাবালো। আমরা কি আদৌ বলার মতো কোনো কথা বলি কখনও? কার কথা কে-ইবা শুনছি। কে-ইবা বুঝতে চেষ্টা করছি অপরপাশের মানুষের অনুভূতিটুকু? সবাই বলে যাচ্ছি, শুনবার কেউ নেই। অকপটে কথা বলবার মানুষ কি আমাদের সবার সত্যিই আছে? যাকে নির্দ্বিধায় বলা যায় ঘুমের মাঝে দেখা বিচ্ছিরি কোনো স্বপ্নের কথা? কিংবা নিজের সবচে তিক্ত অভিজ্ঞতাটির কথা? কিছু না কিছু দ্বিধাবোধ হয়ত থেকেই যায়। নিজের গভীরতম কথাটির প্রকাশের অন্য অর্থ যে নিজের আত্মাটুকু অন্যের হাতে তুলে দেয়া। তাকে পরাধীনতার শেকলে বন্দি করা, যেখানে কি না শেকলের তালাচাবিটুকু নিজ হাতে নয়, বরং অন্য কারো হাতে চিরদিনের জন্যে অফেরতযোগ্য হিসেবে তুলে দেয়া।

তাই হয়ত একা থাকাটাই সবচেয়ে নিরাপদ। বড়দের ছায়ায় হেঁটেও সুখ নেই, সমাজ আঙুল তুলে বিদ্রূপ করবে। সমবয়সীদের সাথে খাপ খাইয়ে উঠতে পারিনি কখনই। অন্তত শিখবার কিছু পাইনি। তাই কাঠপুতুল আর অরণ্যসখাকে ঘিরে চুপচাপ লিখে যাই বিষাদের দিনলিপি। কিছু কিছু মানুষ এতটাই নির্বোধ, naïve, দুর্বল, ভঙ্গুর, ভীত আর অপাংক্তেয় হয় যে সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। বুঝে উঠতে পারে না সমাজের নিয়ম কানুন, কিংবা তার বয়সের সৌন্দর্য, কিংবা বন্ধুত্বের মর্মার্থ। আমি নাহয় তাদের তালিকায় একটা নাম যুক্ত করলাম চেপেচুপে। তবু বেঁচে থাকলাম। নিজের মত করে। তারচে বড় কিছু কি হতে পারে?

“কাচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে হয়,
দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি
পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট
যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি
…………………………………..
ইচ্ছে করে লণ্ডভণ্ড করি এবার পৃথিবীটাকে
মনুমেন্টের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে বলি
আমার কিছু ভাল্লাগেনা”।

-ইচ্ছে/সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়