পরাজিত


জীবনে পরাজয়ের স্বাদ পেয়েছিলাম খুব ছোটবেলায়। ক্লাস ফাইভে। সবচে প্রত্যাশিত ক্যাণ্ডিডেট হয়েও সেবার কেন যেন পেলাম না। মেরুদণ্ডটাই ভেঙে গেছিল। যার পর থেকে স্কুল কলেজে শত ভালো রেজাল্ট করেও নিজেকে কোনোদিন ভালো ছাত্রী হিসেবে স্বীকার করতে পারিনি। আমি তো জানি, আমি তা নই।

সেই ভাঙা মেরুদণ্ড জোড়া লাগতে সময় লেগেছিল প্রায় ছয় বছর। তবুও কোনোদিন স্বীকার করিনি যে আমি ভালো ছাত্রী। আমি ভালো পারি। ভালো বুঝি। ভালো জানি। শুধু পড়ে যেতাম। কী করব, আর কিছু যে করার ছিল না।

২০১২ এর শেষে বড়সড় ধাক্কাটা খেয়েও হার মানিনি। বিধ্বস্ত শরীর আর মন নিয়ে চালিয়ে গেছিলাম। নিজের পরিশ্রমের উপর আস্থা ছিল। ভেবেছিলাম, পরিশ্রম দিয়েই সব জয় করা যায়। আমার শ্রেষ্ঠতম ভুল ভাবনা।

২০১৪ এর দুই তৃতীয়াংশে এসেও একইভাবে ধাক্কা খেলাম। পরপর দু বার। পাবলিকে পড়ার আশাটা বিসর্জন দিতেই হল।

পরিশ্রম দিয়ে সব জয় করা যায়- এ প্রকৃতপক্ষে অমেধাবীদের উদ্দেশ্যে মেধাবীদের সান্ত্বনাবাক্য মাত্র। মেধাবীদের ভদ্রতা আর উৎসাহের ছলে বিদ্রূপমাত্র। বিষয়টা সত্য যে নয়- এ আমি বহুবার দেখেছি। বহুবার হতাশায় আচ্ছন্ন করেছে আমাকে।

প্রশ্ন হল, কী পেলাম আমি অবশেষে। হয়ত বা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি হার না মানার ক্ষমতা। কিন্তু শেষমেষ সাফল্য জিনিসটা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেল। পরাজিত করে গেল কাঠপুতুলকে।

তবু জীবন থেমে থাকে না। থাকবে না। ঘড়ির কাঁটা আমার বিষাদে স্তব্ধ হয়ে যাবে না। সূর্য আমার হতাশা আর কষ্টে সমব্যথী হবে না। তাদের নিয়ম মেনেই চলতে হবে। আমারও তাই থেমে থাকবার উপায় নেই। হয়ত বিধাতার এই ইচ্ছে। আর্কিটেকচার নিয়ে পড়া। হয়ত ওতেই আমার সাফল্য লুকিয়ে আছে। কে জানে!

বিধাতার প্রতি আমার নিদারুণ অভিমান। তিনি বলেন, ভাগ্যকে নিজের হাতে গড়ে নিতে হয়। আমি আমার সর্বোচ্চটুকুই দিয়েছিলাম। তবুও তো আপনজনদের ইচ্ছেপূরণ করতে পারলাম না। তবে আমি কিভাবে নিজের ভাগ্যকে গড়ে নেবো?

তবে এটুকু শিখে নিলাম, বিধাতা পরিশ্রমের কোনো মূল্য দেন না। হয়ত বা বিধাতা বলেই কিছু নেই। যদি বা থাকতোই, তবে এমন নিদারুণ নিষ্ঠুর তিনি কিভাবে হতে পারেন?

কে জানে!

লেখাটা কেমন টুকরো টুকরো হয়ে গেল। সত্যি বলতে কী, জীবনটাই তো কেমন টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। যাচ্ছে। হয়ত আরো যাবে। হয়ত এমন করেই ভেঙেচুরে গড়ে উঠবে অন্য এক কাঠপুতুল।

কি বিচিত্র আশাবাদী হয়ে উঠেছি দেখেছ রোদ্দুর?

তবু শেষমেষ কাঠপুতুলের পেছনে একটা ছোট্ট বিশেষণ যোগ করে দেওয়াই যায়।

পরাজিত।

লজ্জিত।

সত্যিই, কী ভীষণ লজ্জিত আর ক্ষুদ্রই না লাগছে নিজেকে। হয়ত তাই আন্তর্জালিক সব যোগাযোগ মাধ্যম থেকে সরে গেলাম চুপচাপ। ফেসবুক স্থায়ীভাবে মুছে ফেলবার আবেদন করলাম। স্রেফ কাঠপুতুল আর ফ্লিকার। পুরনো মানুষদের মুখোমুখি আর হতে চাই না। তারাও যদি আর মুখোমুখি না হয়, তবেই সুখী হই, কৃতজ্ঞ হই। সত্যি বলতে মুখোমুখি পড়ে গেলে আমার আর লুকোনোর জায়গা থাকবে না।

কী দুঃসহ লজ্জা!

3 thoughts on “পরাজিত

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান