জানা নেই


আজ সাতদিন হল সার্জারির। ১৮টা স্ক্রু আর চারটে প্লেট মুখে নিয়ে আর ঘুরতে ভালো লাগছিল না। খুলেই ফেললাম অবশেষে। ডাক্তার যদিও বলেছিল মুখের ভেতর থেকেই কেটে খোলা যাবে, কিন্তু অপারেশানের মাঝপথে গিয়ে আবিষ্কার করলেন ডানপাশের স্ক্রুগুলো ঘুরানো যাচ্ছে না। অতঃপর পুরনো ক্ষতের ওপরই আবার ছুরি চললো এবং খুলে এনে সেলাই পড়লো।

এ তো শারীরিক কিছু ক্ষত মাত্র। রোজ রোজ কত পুরনো ক্ষতের ওপর নিত্য ছুরি আর সেলাই দুই-ই পড়ছে, তার খবর রাখবার মত কি কেউ আছে?

এবার খানিক বিস্মিতই হলাম। অপারেশান থেকে বেরিয়ে দুটো প্রিয় মুখকে ভেবেছিলাম পাশে পাবো। পাইনি। জ্ঞান ফিরবার পরে মা’কে দেখে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পরী?’ মা জানালো আসতে পারেনি। অপরজন যে আসবে না, তা আগেই জানা ছিল। সে নিয়ে খানিক মান-অভিমানও চলেছিল ঘণ্টাখানেক। তবে আমি কি না দুর্বল এবং ভঙ্গুর। অভিমানটুকু পুষে রাখতে জানি কেবল বুকে, মুখে নয়।

যখন জ্ঞান ফিরল, প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় থরথর করে কাঁপছি। দুটো কম্বল চাপিয়েও কাঁপুনি থামানো যাচ্ছে না। হাতে ক্যানুলা করা, স্যালাইন যাচ্ছে, হাতকে তাই কম্বলের উষ্ণতা দিতে পারছি না। কারো হাতের প্রয়োজন ছিল খুব। পেলাম না। অকস্মাৎ বাবা সামনে দাঁড়ালো। কাঁপতে কাঁপতে বললাম, ‘ধরো’। হাত তখন জমে বরফ।

সত্যিই, মাঝেমধ্যে এমন কিছু মুহূর্ত এসে দাঁড়ায়, কিছুতেই আর উষ্ণতা কিংবা আশ্রয় খুঁজে পাওয়া যায় না। অপর কোনো মানুষের প্রয়োজন হয়। আমার তেমন কেউ ছিল হয়ত। এখন নেই। কিংবা আছে।

জানা নেই।

..

শীত বিদায় নিচ্ছে দ্রুত। কুয়াশার সাথে মাসব্যাপী যুদ্ধ করে বরাবরের মতই সবশেষে সূর্যই জয়ী। তার তপ্ত নিঃশ্বাসে পৃথিবীকে ত্রস্ত করে তুলতে প্রস্তুতি নিচ্ছে যে, তা দুপুরের রোদে চোখ রাখলেই বোঝা যায়।

আমার প্রিয় মানুষেরাও বিদায় নিতে উদ্যত। জীবনকে গুছিয়ে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। পরী হারিয়ে যাবে এ বছরের মাঝেই। কাপভর্তি আনন্দে দু-এক দানা বিষাদ যে মেশেনি, তা বলা চলে না। যারা নতুন জগতে হারিয়ে যায়, তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আমরা যারা বুড়ো বন্ধুদের ছায়ায় স্বচ্ছন্দবোধ করি, তাদের জন্যে বিষয়টা খানিক অস্বস্তিকর। অবশ্য আমরা সংখ্যায় কম, তাই হয়ত তেমন একটা বুঝতে পারে না কেউ। নতুন জীবন সবসময়ই আনন্দের, তবে পুরনোকে হারানোর বিষাদ কি তাদের ছোঁয়?

জানা নেই।

..

ভীষণ ইচ্ছে করে, পুরনো সবকিছু ঝেড়ে ফেলে আবার নতুন করে শুরু করি। সে জীবনে আপন বলে কেউ থাকবে না। মায়া শব্দটা স্রেফ এক অজানা বর্ণবিন্যাস হয়ে থাকবে। জীবনটুকু সাজাবো স্বার্থপরতা আর আত্মকেন্দ্রিকতা দিয়ে। কারো কথা ভেবে নিজের সময়টুকু তার জন্যে সাজাবার প্রশ্ন উঠবে না। মায়াহীন জীবন।

হায়, যদি ‘হও’ বললেই হয়ে যেত সব!

‘হও’ বললেই যদি ক্ষতচিহ্নগুলোকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারতাম!

‘হও’ বললেই যদি প্রিয় মানুষগুলোকে নিমেষে অপ্রিয় করে তুলতে পারতাম!

‘হও’ বললেই যদি ঘুম ভেঙে ভুলে যেতাম, আমি কে, কেন জন্মেছি, কেনই বা মারা যাবো!

সে তো হবার নয়।

অকৃত্রিম বিষাদের এক জীবন আমাদের। ছবিয়াল বলছিল, জীবন সৃষ্টির প্রক্রিয়াটাই জটিল, কাজেই জীবন যদি জটিলতার হয়, তবে বিধাতাকে দোষ দেওয়া চলে না। সত্য বটে। দোষ যদি দিতে হয়, তবে সে দিতে পারি, করোটির মধ্যে থাকা ১৪০০ গ্রামের পিণ্ডটুকুকে। অনুভূতিগুলোকে তো নিয়ন্ত্রণ করছে সেই।

আমার উত্তরাধিকারদের আমি তৈরি করবো নিষ্ঠুররূপে। যেন এই মায়া, বিষাদ, প্রিয়তা, আবেগ, অনুভূতি বিষয়গুলো তাদের নিত্যকার জীবনকে হতাশায় ভাসিয়ে দিতে না পারে। এসব স্রেফ সর্ববিধ্বংসী। জীবনকে যেভাবে জটিল থেকে জটিলতর হিসেবে আবিষ্কার করছি, ওতে, এসব অনুভূতি বহন করে বেড়াবার মানে হয় না। চাইলে অলঙ্কারস্বরূপ রাখাই যেতে পারে হৃদয়ের ক্ষুদ্র কুঠুরিতে, তবে সিদ্ধান্তগুলো নেবার বেলায় এসব অনুভূতি যেন মৃতবৎ থাকে, তা নিশ্চিত করা জরুরি। তাই নয় কি?

জানা নেই।

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান