খামবন্দি অনুভূতি : হাসিকান্নার গল্প


প্রিয় রোদ্দুর,

মাঝেমধ্যে কী এমন হয় না, ভীষণ বিষাদে হৃদয় কেমন যেন নুইয়ে পড়ে? অদ্ভুত একটা কথা, বুঝতে পারছি, এর মাঝেই নাকমুখ বিকৃত করে উৎকট একটা মুখ করে ফেলেছো। পেছন ফিরে লাইনটা পড়ে নিজেই হেসে ফেললাম। আজকাল অকারণে হাসি। হাসি নিয়ে সবচে মজার ঘটনাটা হয়েছে দিনদুয়েক আগে। কি কারণে এক বন্ধুকে ফোন করে কথা বলতে বলতে হঠাৎ করে কেঁদে ফেললাম। এই আর এক জ্বালা! কান্না শুরু করলে থামানোটা মুশকিল হয়ে যায়। অবস্থা বেগতিক দেখে বন্ধুটি বলল, “কাঁদতে কাঁদতে বন্যা ভাসায় দেবে নাকি?” একটু থেমে চোখ মুছে বললাম, “বন্যা হয় নাকি কাঁদতে কাঁদতে?” বলল, “এই যে, ফোনের এই পাশে পানি চলে এলো যে! ফোঁটা ফোঁটা…” শুনেই হাসিতে ফেটে পড়লাম। বললাম, “এই ব্যবস্থা থাকলে তো বেশ হতো। ধরো, কারও উপর খুব রাগ। ফোন দিয়ে এপাশ থেকে পানি ঢালা শুরু করবো, সব পানি কানের এ পাশ থেকে ওপাশে গড়িয়ে যাবে!” হাসি থামানোটা কষ্টকর হয়ে গেছিল সেদিন।

আপাতত তেমন কোনো হাসির কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তবে জানো বোধহয় হাসির জন্যে আমার তেমন কোনো কারণ লাগে না। এ মুহূর্তে সেরকম কারণও খুঁজে পাচ্ছি না, যাতে প্রাণখুলে হাসা যাবে। হুমম, ফেসবুক খোলা আছে। বিভিন্ন মজার পেজের ছবিগুলো দেখে সাময়িক একটা হাসি খেলে যায়, তবে সেটা স্থায়ী নয়। নিজের মাথায় কোনো উদ্ভট জিনিস কল্পনা করে হাসতে অন্যরকম একটা আনন্দ আছে। যেমন ধরো, আম্মুর সামিলকে ছাই দিয়ে ঘষে ঘষে গোসল করানো কিংবা রাস্তার ধারে গাছের নিচে চায়ের কাপ হাতে বসা কারো চায়ে উপর থেকে টুপ করে কিছু একটা এসে পড়া…; থাক, রাত দুটো বাজতে দশ মিনিট বাকি, এখন একা একা হাসলে স্থায়ীভাবে মানসিক হাসপাতালে ব্যাগ গুছিয়ে থিতু হতে হবে হয়ত!

সেটা হয়ত খারাপ হত না। বাসায় থাকতে থাকতে আমার অবস্থা হয়েছে ছোটবেলার সেই কলমের ম্যাজিকটার মত। দুটো কলমকে আড়াআড়ি কিছুক্ষণ একেবারে স্থির করে ধরে রাখলে তারপরে সেটাকে ওঠাতে গেলে একটু বাধা পেতে হয়। কেমন যেন চুম্বকের মতো টেনে রাখে কলমদুটো। আমার অবস্থা হয়েছে কলমদুটোর মতো। এখন আর একদমই বেরোতে ইচ্ছে করে না। স্বেচ্ছানির্বাসনে আছি। নিজেকে নিজের জগতেই নির্বাসন দিয়েছি। ভালোই লাগে। ভালো লাগতোও একসময়। তবে মাঝেমধ্যে ভীষণ ক্লান্ত লাগে। পালাতে ইচ্ছে করে। একা একা পালাবোও বা কোথায়? বড়জোর এই শহরের অলিগলি পর্যন্তই হারাতে পারবো। আমার সাদা-নীলাভ আকাশ কিংবা সবুজ সিক্ত শিশিরের স্পর্শ এই ইট-কাঠের শহরে আমি কোথায় পাবো? পালিয়ে তো উদ্দেশ্য সাধন হবে না। লাভ কী?

তাই ইচ্ছেটাকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। ঘুমাক, যখন আমার অঢেল সময় হবে, যখন আমার কাছে কারও কিছু চাইবার থাকবে না কিংবা যখন নিজের কাছে নিজেরই কিছু চাইবার থাকবে না, তখন ইচ্ছেটাকে জাগিয়ে দেবো। সাবধানে তার গায়ে সূর্যরশ্মি ছুইঁয়ে বলবো, “রাজকন্যা, তোমার ঘুম ভাঙবার সময় হলো”। তারপর…

তারপর নিঃসীমভাবে ছুটে বেড়ানো। ভাবছো, ছুটতে কেন হবে? কিংবা কেন ধীর পায়ে হাঁটবো না? আহ, এত খুঁটিয়ে প্রশ্ন কোরো না। সবুজ ঘাস কিংবা নরম মাটির দেখা পেলে তাতে ধীর পায়েই হাঁটবো। ঘাসফুলগুলোকে এড়িয়ে, তাদের বড় কষ্ট হয় জানো? হুমম, তোমার জানার কথা নয়। কেমন করেই বা জানবে? কখনও কি দেখেছো, তোমার পাশে, তোমারই মতো একজন মৃতবৎ নুইয়ে পড়ে আছে? আমি দেখেছিলাম। সে কথা আরেকদিন হবে। আপাতত একটু স্বার্থপর হই।

বোধহয় খানিকটা উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছো। বিষাদে কিভাবে হৃদয় নুইয়ে পড়ে, তা জানতে। একেকজনের কাছে হয়ত এর ব্যাখ্যাটা একেকরকম হবে। আমার কাছে বিষাদে নুইয়ে পড়া মানে প্রবল বিষাদে অসীম নৈঃশব্দ্যের মাঝে ডুবে যাওয়া। সামনের ফেব্রুয়ারিতে আঠারোয় পা দিচ্ছি, তবে সেটা পৃথিবীতে আমার বিচরণকাল মাত্র। মনের দিক থেকে আমি আঠারোর ধারে কাছেও বোধহয় পৌঁছোইনি। এখনও অনেক কিছু বুঝি না, জানি না, চিনি না। তবে পার্থিবভাবেই টিনেজটাইমটা পেরিয়ে যাচ্ছি। টিনেজটাইমের কোনো শ্রুতিমধুর বাংলা জানলে জানিও। এটার আভিধানিক বাংলাটা আমার ভালো লাগে না। যা বলছিলাম, আগে বোধহয় দেখেছো, রেগে গেলে কিংবা বিষণ্ণ হলে কোনো না কোনোভাবে সেটাকে বের করে দিতাম। কে যেন বলেছিল, রাগী মানুষদের হৃদয় পরিচ্ছন্ন থাকে। হয়ত নিজের হৃদয়কে পরিচ্ছন্ন রাখতে চাইতাম বলেই সেই ক্রোধটাকে বের করে দিতাম। এখন আর দিই না। এখন নীলাকাশে ভাসিয়ে দিই। আকাশের হৃদয়টা কত বড় দেখেছো? কতকিছু সে দেখে, কতকিছুকে সে টেনে নেয়, কতকিছুকে সে সহ্য করে নেয়। আমাদের হৃদয় আকাশের মত এমন বড় হয় না কেন? মাটির পৃথিবীতে থেকে আমাদের হৃদয়টা এমন কর্দমাক্ত, ধুলোমাখা হয়ে যায় কেন?

বারবার এ কথা থেকে সে কথায় চলে যাচ্ছি। আজ বড় বিক্ষিপ্ত লাগছে। অথচ এখন আমার থাকা দরকার শীতের সমুদ্রের মত শান্ত, ঢেউহীন। অথচ আজই যেন ঘূর্ণিঝড়ের মত প্রচণ্ডবেগে সবকিছুকে ধ্বংস করে দিতে চাইছি। এটা বোধহয় ঠিক ধ্বংস করবার ইচ্ছেও নয়। কী হতে পারে? আগ্নেয়গিরি? উপমাটা খানিকটা হাস্যকর। তবে বোধহয় এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত উপমা। জার্নি টু দ্য সেন্টার অফ দ্য আর্থ সিনেমাটা আমার খুব প্রিয় ছিল। শেষদিকে এরকম একটা দৃশ্য ছিল। একটা সুপ্ত আগ্নেয়গিরির আশেপাশে সবুজের সমারোহ, হঠাৎ করে ভেতর থেকে পাথর বেরিয়ে আসতে শুরু করলো প্রবল বেগে। এরকম কিছু একটা। মনে পড়ছে না।

যা বলছিলাম, আঠারো। এখন কেন যেন আর সেভাবে রাগটাকে প্রকাশ করি না। রাগ হলেও নিজেই নিজেকে শান্ত করি। কেন যেন সর্বক্ষণ একটা অসহায় অনুভূতি হতে থাকে। মনে হয়, খুব অল্প সময় হাতে আছে, সেটুকু যদি রাগের মত অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ব্যয় করি, তাতে কোনো সুখ নেই। আজকাল আর আগের মত মন খারাপও করি না। তার অবশ্য কারণ আছে। সময় কোথায়? প্রচণ্ড ব্যস্ত থাকি আজকাল। মনখারাপের ক্ষেত্রেও হয়ত সেই অল্প সময়ের তাড়নাটা কাজ করে। হেসে ফেলি, শান্ত থাকি, স্বাভাবিক থাকতে চেষ্টা করি।

আজ আর লিখছি না। বিশাল লম্বা চিঠি হয়ে গেলো। একটা বাক্য দিয়ে কতকিছু লিখে ফেললাম দেখেছো? তবুও যেন অনেক কিছু বলা হলো না। ঠিক যেমন সুনীলের মত। কত কাজ বাকি রেখে চলে গেলেন। তার প্রথম আলো বইটা পড়া শেষ করিনি এখনও। তবে ভীষণ ভালো লাগছে পড়তে। সবচেয়ে ভালো লেগেছে ভূমিসূতাকে কেন্দ্র করে চরিত্রগুলোর আবর্তন, আর হ্যা, কাদম্বরীর চরিত্রাঙ্কন। পড়াশোনা সামলে নিয়ে আশা করি বাকি লেখাগুলোও পড়ে নিতে পারবো। এর মাঝে সত্যজিতের ছোটগল্পগুলো পড়া হয়েছে। ।“বর্ণান্ধ” গল্পটার কথা প্রায়শ মনে পড়ে।

“কী ভাবছো তুমি? ভাবছ আমি দুর্বল! ভাবছ যে, ভাগ্যের চাকার তলায় সেইজন্যেই আমি গুঁড়িয়ে গেছি! নিজের কথা বলতে পারি, আমি যে আত্মহত্যা করিনি কেন, এই কথা ভেবেই আমি অবাক হয়ে যাই। কারণটা হয়ত এই যে, বাঁচতে আমার ভারী ভালো লাগে, আর নয়ত আমি ভীতু, কাপুরুষ। হয়তো সেটাই সত্যি কথা। নইলে দ্যাখো আজ আমার কাছে জীবনের কী অর্থ? শিল্পের কী অর্থ? যে লোক ধূসর ছাড়া…হরেক রকমের একঘেয়ে ধূসর ছাড়া কোনও রঙই দেখতে পায় না, সেজন্যে মাতিস আর রেনোয়ার ছবিরই বা তার কাছে কী অর্থ?”

ভালো থেকো।

-কাঠপুতুল

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান