খামবন্দি অনুভূতি : মায়া ও স্বার্থপরতার কথা


প্রিয় রোদ্দুর,

কখনও এমন হয় আশেপাশের কাউকে আমরা এত বেশি আপন ভেবে ফেলি, তাদেরকে খাঁচাবন্দি করে ফেলি। আটকে ফেলি। কোত্থাও যেতে দিতে চাই না। কেমন যেন মায়ামাখানো স্বার্থপরতা! দেখো, স্বার্থপরতা কত বাজে জিনিস, তবুও তার সাথে মায়া মিশে গেলে, হয়ত সেটাও আমাদের আকাঙ্ক্ষিত হয়ে ওঠে। আমরা কেউ কেউ সেই মায়ামাখানো স্বার্থপরতা দেখিয়ে যাই, আর অপর পাশের মানুষটাও সেই স্বার্থপরতাটাকে উপভোগ করে, খুব বেশিদিনের পরিচয়, কিংবা পারস্পরিক মায়াটা খুব বেশি হয়ে গেলে হয়ত খানিকটা অসহায়ভাবে খাঁচার দরোজা খুলে পালিয়ে যেতে চায়। পালাতে গিয়ে আটকে পড়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের জালে। “যাবো? এত মায়া ছেড়ে কোথায় যাবো?” কিংবা “ওর মন ভেঙে যাবে! ওতে কি আমার সুখ হবে?” সবশেষে, “নাহ, আমি যাবোই। কারও মায়ার বাঁধনে আমি বাধা পড়তে রাজি নই। তাও এমন স্বার্থমাখানো মায়া!” কিংবা, “থাক, অতটুকু মায়াও একসময় হয়ত আর আমার জন্যে জমা থাকবে না। যদ্দিন আছে, ততদিন না হয় থাকি…”

কি জানি! আমি অমন মায়ার বাঁধনে আটকা পড়েছি বহুবার। তবে প্রতিবারই মায়াময় মানুষগুলো স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়েই আমাকে মুক্ত করে দিয়েছে। কৃতজ্ঞতা সেইসব মানুষদের প্রতি…

তারপর আমি ছন্নছাড়া পাখির মত উড়ে বেড়াই। অন্যের ঘরে খানিক সময়ের জন্যে আশ্রয় নিই। আবার পালাই, কিছু না জানিয়ে। কিন্তু শেষবার আবার ধরা পড়লাম। খুব ভালোভাবেই ধরা পড়লাম। এখন পর্যন্ত ছেড়ে দেবার নাম করছে না।  সম্ভবত করবেও না। কে জানে! মানুষের মন…। হয়ত দেখা যাবে কোনো এক বিষাদী রাতে খাঁচা খুলে বলবে, “যাও! মুক্ত করে দিলাম তোমায়!” কী করব আমি তখন? উড়ে যাবো খুশিমনে? নাকি তখন নিজেই নিজেকে জোর করে খাঁচার ভেতর আটকে রাখবো। তার খাঁচা থেকে মুক্ত হতে চাইবো না? হতেও পারে!

ভাবছো, আমি, যে কি না, বারবার মুক্ত হয়ে উড়ে যেতে চেয়েছি, সে কেন নিজেকে মুক্তজীবন থেকে মুক্তি দিয়ে আটকে রাখতে চাইবো? ওই যে, স্বার্থমাখা মায়া! আমার স্বার্থমিশ্রিত মায়ার টানেই আমি যেতে চাইবো না। শেকলবন্দি হয়ে থাকবো আজীবন। কি বিচিত্র মানুষের মন!

আজ সকালে আমার এই খাঁচাবন্দি পাখিটির দুশ্চিন্তায় অসময়ে উঠে গেলাম। হুম, সকালটা আমার ঘুম ভাঙার পক্ষে অসময়ই বটে। রাতেও ঘুম হয়নি। অস্থিরতায় ছটফট করেছি সারারাত। কারণটা স্রেফ মায়ামাখানো স্বার্থপরতা। তাকে আজ দিনকয়েকের জন্যে মুক্ত করে দিচ্ছি। কিন্তু চাইছি না। আমি হয়ত আজীবন খাঁচাবন্দি থাকতে রাজি আছি, পাখিটি তা নয়। তার মুক্তজীবনে সে কারও বাধা মানবে না। আমিও দ্বিধান্বিত হয়ে যাই, স্বাধীনতার মাঝে আমি পরাধীনতার ছায়া ফেলবার এমন কে? তবুও অযাচিত অধিকার খাটাই। ভাবি, যেতে দেবো না। কোনোভাবেই না। অমন খুঁজে খুঁজে হঠাৎ পাওয়া পাখিটিকে এত সহজে যেতে দেবো? যদি সে হারিয়ে যায়? পথ ভুলে আর ফিরে না আসে? শঙ্কায় আকুল হয়ে থাকি।

তবুও, শেষমেষ কিছু করার থাকে না। কিছু পাখিকে সাময়িকভাবে পাওয়া যায়, খাঁচাবন্দি করে, মায়ার শেকলে বেঁধে খানিক আনন্দ পাওয়া যায়; তবু তাদের মন পাওয়া যায় না। কেন পাওয়া যায় না, তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। আমরা কারও কারও জন্য কখনও সব সুখ উৎসর্গ করে দিতে প্রস্তুত থাকি, তারা থাকে না, তারা চায় না, ভাবে, “একসময় সব বাঁধা ছেড়ে পালাবো, ওকে আমার ভালো লাগে না। যাকে ভালো লাগে না, তার জন্যে কেন সব সুখ উৎসর্গ করে দেবো? ও আমি পারবো না’।

একটা কবিতা থাকলো শেষে। হয়ত বুঝবে। তুমি কবিতা আমার থেকে অনেক ভালো বোঝো।

“হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে,
মন বাড়িয়ে ছুঁই,
দুইকে আমি এক করি না
এক কে করি দুই৷

হেমের মাঝে শুই না যবে,
প্রেমের মাঝে শুই
তুই কেমন করে যাবি?
পা বাড়ালেই পায়ের ছায়া
আমাকেই তুই পাবি৷

তবুও তুই বলিস যদি যাই,
দেখবি তোর সমুখে পথ নাই৷

তখন আমি একটু ছোঁব,
হাত বাড়িয়ে জড়াব তোর
বিদায় দুটি পায়ে,
তুই উঠবি আমার নায়ে,
আমার বৈতরণী নায়ে৷

নায়ের মাঝে বসব বটে,
না-এর মাঝে শোব৷
হাত দিয়ে তো ছোঁব না মুখ,
দু:খ দিয়ে ছোঁব৷

তুই কেমন করে যাবি?

–   যাত্রা-ভঙ্গ/নির্মলেন্দু গুণ

প্রশ্ন রইলো শেষে।

শুভ হোক যাত্রা।

ইতি,

কাঠপুতুল

5 thoughts on “খামবন্দি অনুভূতি : মায়া ও স্বার্থপরতার কথা

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান