চোখ


খুব মনোযোগ দিয়ে গোল্ডফিশগুলোকে লক্ষ করছিলাম। অদ্ভুত একটা গোল্ডফিশ বারবার নজর কেড়ে নিচ্ছিলো। মাছটার চোখের কোটরটা শূন্য। কিন্তু বেশ চমৎকারভাবে পাখনা নেড়ে নেড়ে স্বচ্ছ জলের মাঝ দিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। আশেপাশে আরও অনেকগুলো ক্ষুধার্ত গোল্ডফিশ ভাসছে। ভাসছে একজোড়া কালো শার্কার। গোল্ডফিশটা জানে না, সে কতটা আকাঙ্ক্ষিত। তার মৃত্যু কতটা আকাঙ্ক্ষিত এই রোজ একঘেয়ে ছোট লাল দানার খাবার খাওয়া পোষা মাছগুলোর কাছে। সে জানে না, তার চারপাশে স্বচ্ছ জলের মাঝে একটা নোনা ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে, মৃত্যুদূত তার নোনা সুবাস ছড়িয়ে তার পিছু পিছু ঘুরছে। আচমকা হয়ত গোল্ডফিশগুলো ঝাঁপিয়ে পড়বে তার ওপরে। তার নরম সোনালি শরীর একটু একটু করে একটা ঠুকরে ঠুকরে খাবে তারই এতদিনের বন্ধুরা, তার এই বন্দিজীবনের বন্ধুরা। দিন পেরোবে, রাত পেরোবে, ঘড়ির কাঁটাগুলো একটার পর একটা সংখ্যা পেরিয়ে যাবে। আমার এই অন্ধ বন্ধুটির শরীর ততক্ষণে চাপা পড়বে সাদাকালো মার্বেল পাথরের নিচে। শেষমেশ হয়ত একটা মাঝারি আকারের কাঁটা খুঁজে পাওয়া যেতে পারে ভাসমান অবস্থায়। নাও পাওয়া যেতে পারে।

 

বন্ধুটির জায়গায় হয়ত আর একজোড়া নতুন গোল্ডফিশ নিয়ে আসা হবে। সূর্যাস্তের আবির রঙা তার ছোট্ট শরীরের মাপের আরেকটা গোল্ডফিশ। বছর তিনেক পরে নতুন গোল্ডফিশটা আমার মতই কিশোর হয়ে উঠবে। আমার মত প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠবে। তাকে আমি অন্ধ হতে দেবো না। সে দেখতে পাবে তার মুখোশপরা রূপবান বন্ধুদের। দেখতে পাবে তার মৃত্যু্র আকাঙ্ক্ষারত বন্ধুদের। তাদের থেকে নিজেকে রক্ষা করে চলবে। আবার সময় পেরোবে, দিন পেরোবে, রাত পেরোবে, দেয়ালঘড়িটার কাঁটাগুলো ৩৬০ ডিগ্রী কোণ পরিভ্রমণ করতে করতে টেবিল ক্যালেন্ডারকে জানান দেবে তার বেশ পরিবর্তন করবার কথা। ততদিনের বন্ধুটি হয়ে উঠবে হান্স ক্রিশ্চিয়ান এ্যাণ্ডারসনের সেই কুচ্ছিত হাঁসের গল্পের হাঁসের মত। ছোট্ট এক রত্তি গোল্ডফিশ ক্রমে ক্রমে হয়ে উঠবে রূপবান ঈর্ষণীয় একটা মাছ।

 

আহ! কবে আসবে সেদিন? ততদিন পর্যন্ত কি আমার এই অন্ধ বন্ধুটিকে বাঁচিয়ে রাখা যায় না? তাকে এই মৃত্যুকামী বন্ধুদের থেকে দূরে সরিয়ে তাকে নতুন জীবন দেওয়া যায় না? নাইবা দেখতে পেল সে আমাকে। কিন্তু তার প্রতি তো আমার ভালোবাসার অন্ত নেই। আমার ধারণা তার অন্ধ জীবনকে সে বেশ পছন্দই করবে। আমরা দু’জন একসাথে সাঁতরে বেড়াবো আলোহীন এক জগতে। কি এসে যায়? আমার মাছবন্ধুটিও জানে না তার মুখোশপরা শত্রুদের পরিচয়, আমিও জানি না। কি অসম্ভব একটা মিল আমাদের মাঝে! আমাদের জীবন এমনিভাবেই ভাসমান। এক কাঁচবাক্সে, একই জলে, একই কৃত্রিম ভাসমান গাছের মাঝে আমাদের বসবাস…

 

“আম্মু, দেখো এ্যাঞ্জেলমাছটাকে সবগুলো মাছ ঘিরে ধরেছে! ঠোকরাচ্ছে!” “ওরকম একটু হয়ই সোনা। তুমি বরং একটু বাগানের দিকে যাও। নতুন গোলাপ চারাগুলো লাগানো হচ্ছে”।

 

আমি তবুও খুশি। ক্ষুধার্ত গোল্ডফিশগুলোর সাথে আমার চুক্তি হয়েছে। আমি মারা গেলে তারা আমার চোখদুটোকে উপড়ে তুলে আমার বন্ধুটির চোখে বসিয়ে দেবে। কি চমৎকার একটা চিন্তা! সমুদ্রে থাকতে মা বলত, আমি খুব বুদ্ধিমান একটা বাচ্চা। মা থাকলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হতেন। মা বলতেন, বন্ধুদের জন্য সব উজাড় করে দিতে হয়। আমি আমার চোখ দিয়ে দিচ্ছি আমার বন্ধুটিকে। এখন সে একটা অপূর্ব গোল্ডফিশ হয়ে উঠতে পারবে। তার চোখ থেকে আমার চোখ দিয়ে কাঁচবাক্সের গায়ে বন্ধুটির নিত্য পরিবর্তন দেখতে পাবো। দেখতে পাবো আমাদের জলজ জীবনকে।

 

-“আম্মু, এটা কিভাবে হল?”

-“জানি না সোনা।“

-“কি বীভৎস! একুরিয়ামের একটা মাছেরও চোখ নেই! চোখহীন এতগুলো মাছ ভেসে বেড়াচ্ছে!”

-“এই যে এই গোল্ডফিশটার এখনও চোখ আছে! এটাকে একটা জারে দিয়ে দাও সোনা।“

-“কিন্তু আম্মু, এটার চোখটা যেন কেমন! গোল্ডফিশের চোখ কি এমন থাকে?”

-“জানিনা সোনা”।

2 thoughts on “চোখ

  1. প্রিয় ব্লগার, বাংলা ওয়ার্ডপ্রেসের ব্লগার/লেখকদের নিয়ে তৈরি করা ফেসবুকের এই গ্রুপে আপনাকে যুক্ত হওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি।

    https://www.facebook.com/groups/391373174244563/

  2. ohornish বলেছেন:

    আমাদের সংসার থেকে দিবা যেদিন চলে গেলো, সেদিনও এক্যুরিয়ামে একটাই গোল্ডফিশ ছিলো। আর সে ছিলো তার ছয় সদস্যের পরিবারের শেষ জন এবং একা। এক্যুরিয়ামটা সহ আমাদের বাসায় ঘর ছিলো তিনটি, তিন ঘরে আমরা তিন জন। গোল্ডফিশটা তার গড় আয়ু পার করে চলে গেলো। আমরা আছি আমাদের গড়ের অপেক্ষায়…

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান