জানলার কাঁচে অবিরাম জলস্রোত দেখতে দেখতে কাঠপুতুল চেনা সুবাসের অস্তিত্ব টের পায়। একটু হাসে হয়তো। মুহূর্তের মাঝেই পাশে অপর এক আবছায়া এসে দাঁড়ায়।
-মনে পড়ে, কতদিন পেরিয়ে গেছে, যখন বর্ষার দিন একটুকরো জলচিঠিতে লিখে পাঠাতাম, “বেরিও না আজ”?
-বেশ মনে পড়ে। তবে সত্যি কথাটা জানাইনি কখনও।
-আজ শুনবো, বলো। অতীতের যে বর্ষার দিনগুলোতে তোমার হৃদয়ের কথা হৃদয়েই সুপ্ত থাকতো, কালের পরিক্রমায় এই বর্ষায় সেসব মুক্ত হয়ে যাক। মেঘজলে ভেসে যাক চাপা আবেগ…
-আমি কখনই বর্ষার দিনে বেরোতে চাইনে। উদ্দাম বৃষ্টিতে তো নয়ই। ঘরবন্দি মানবীর তপ্ত হৃদয়ে হঠাৎ শীতল জলের স্পর্শ পড়লে তার ফুঁসে ওঠাই স্বাভাবিক। আর সেইসব আকাঙ্ক্ষাকে বিসর্জন দিয়েছি বহু আগেই। সম্ভবত আমার নিয়তি চার-দেয়ালের মাঝেই…
-নাহ, সেটা ভুল।
-ভুল যে নয়, সে খুব ভালো করেই জানি। আশান্বিত করা ভালো। কিন্তু যে জন্মান্ধ, তাকে আকাশের নীল রঙের ক্রমপরিবর্তন দেখানোর আশা না দেওয়াই শ্রেয় নয় কি?
-হয়তো। তবে কাঠপুতুলের ক্ষেত্রে তেমনটা হবে না।
-এতটা নিশ্চিত?
-এলামই তো কাঠপুতুলকে মুক্ত করে নিয়ে যে্তে। তোমার জল ছুঁইছুঁই নৌকো আর মেঘের কোলে ছোট্ট ঘরের স্বপ্ন পূরণ করতে…
-নাহ, সে চাওয়া নেই। সেই নৌকো আর মেঘের কোলে বাড়ি আর কারো জন্যে রেখে দিও। তোমার উপযুক্ত কাউকে…
-সময় আসুক, তারা নিজেরাই উপযুক্তটিকে খুঁজে নেবে।
-অন্তত সেটা আমি নই।
-সময় বলে দেবে।
-আর যদি সময় তোমার কিংবা আমার আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে চলে যায়?
-নিতান্ত দুর্ভাগ্য ছাড়া কী বলব তাকে? তবে উপযুক্ততার কারণে তোমার পদচিহ্নটা সেখানে ফুটে উঠবে আপনা থেকেই।
-জানিও, ফুটে উঠেছিল কি না।
-সে তুমি নিজেই দেখতে পাবে, নিজ চোখে।
-অপেক্ষায় রইলাম। তার আগেই যেন আলো না নিভে যায়।
-সময় আসুক। এখন বর্ষণের গান শোনো। অতীতের সাথে মিল খুঁজে পাও কি না জানিও।
-ভালো থেকো। আর থেকো অপেক্ষায়।
-আমি অপেক্ষায় নেই।
-আমি একাই তবে অপেক্ষায়?
-আমি তো নিশ্চিত কাঠপুতুল, তবে কেন অপেক্ষা?
-বেশ। যাচ্ছ এখনই?
-অরণ্য ডাকছে যে আমায়। সাড়া না দিয়ে উপায় নেই যে!
-বেশ, তোমার আকাঙ্ক্ষাই পূর্ণ হোক। তোমার ভালোলাগা সম্ভবত ওখানেই… আমি ঘরবন্দিই থাকি। মুক্ত অরণ্যে তোমার স্থান, আর আমার এই আঁধারের কোণে। বিদায়।
কাঠপুতুল পাশ ফিরে আর অস্তিত্বটাকে খুঁজে পায়না। তার আগেই সে উড়াল দিয়েছে অরণ্যে। বরাবরের মতই, আকাঙ্ক্ষার বিনাশ ঘটিয়ে।