হঠাৎ দু’কলম..


প্রিয় রোদ্দুর,

বহুদিন পর তোমার আগমনের আগমুহূর্তে তোমাকে লিখছি। হয়ত তুমি বহুদিন বাদে এই আচমকা পত্রপ্রেরণে বিস্মিত এবং খানিকটা শংকিতও হবে, তবুও মনে হল, তোমাকে যখন তখন চমকে দেবার অধিকার কিছুটা আমার আছে। সেই অধিকার বলেই লিখছি।

কতদিন হয়েছে লিখিনি? মাসতিনেক? হবে হয়ত। প্রতি সেকেণ্ডেই পৃথিবী যেন কত কিলোমিটার ঘুরে আসছে, আমার তার সঠিক সংখ্যাবিন্যাসটুকু মনে নেই। তবে তিনমাস জীবন এপাশ ওপাশ উলটে যাবার জন্যে যথেষ্ট। তার কিছু কিছু হয়ত তোমাকে শোনাবো।

কেন শোনাবো, জানতে চাইছ মনে মনে, জানি। হয়ত খানিকটা অভিমান নিয়েই। তবুও, স্বীকার করছি, আর কোনো শোনানোর মানুষ পাচ্ছি না, তাই।

ঈদের ছুটিতে ঢাকা এসেছি। হ্যা, বরিশাল মেডিকেলেই আছি এখনও। ছোট্ট দুই রুমের বাসার কথা বলেছিলাম বোধহয়। সে বহুকাল আগের কথা। আগের কোনো চিঠিতেও লিখেছি কি না, মনে পড়ছে না। খালাত ভাই ভাবী আর তার বাচ্চাদের পরিবারের সাথে থাকি। আলাদা একটা ঘর নিয়ে।

ঘরটা বহুকাল আমার জীবনের প্রায়শ খোলা জানলায় উঁকি দিয়ে যাবে। ছয় বছর নিতান্তই ক্ষুদ্র তো নয়ই, তাকে অবহেলা করাটাও অন্যায়। রোজ সাতটায় উঠি, রুমে রাখা ওভেনে খাবারদাবার রেডি করে কলেজ যাই, কোনোদিন উঠতে দেরি হয়ে গেলে কিছু না খেয়েই দৌড়োই। ক্লাস করি। ভাইভা দিই। হতাশ হই। খুশি হই। বাড়ি ফেরার পথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে আনি। কোনোদিন একটু দূরে যাই, যখন কিছু খেতে ইচ্ছে করে খুব। ফিরে ঘরদোর গুছানো, কাপড় কাচা, ঘুম, মুঠোফোন। সূর্যাস্তের পর ওঠা, কোনো কোনো দিন ক্লান্তিতে ঘুম ভাঙতে ভাঙতে রাত আটটা ন’টাও বেজে যায়। বুধ কিংবা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা কিংবা রাতে কাপড় আয়রন করতে দিয়ে আসা। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়া। আবার আধো ঘুমে সাতটার এ্যালার্ম…

এর মাঝেও টুকটাক অনেক কিছু বাদ পড়ে গেছে লিখতে। আমার অভিমানের মুহূর্তগুলো, প্রায়শ রাতে বাচ্চামেয়ের মত অভিমানের অশ্রুবিসর্জন, সবকিছু সামলে আবার বইপত্র নিয়ে বসা, কঠিন প্রতিজ্ঞা, সবকিছু ছেড়ে পালানোর স্বপ্নবুনন, অভিমান কাটানো, আবার ফেরা..।

সবকিছুর সাক্ষী হয়ে রইল এই চারদেয়াল আর ওপাশের মেহগনি গাছটা।

এখন ঢাকায় এসে মাঝেমধ্যে খুব ক্লান্ত লাগে। মনে হতে থাকে, আমার ওই চারদেয়ালের ঘরটাই তো ভালো ছিল। আমার একান্তই ব্যক্তিগত একটা পৃথিবী। চাইলেই ঘুমিয়ে পড়তে পারছি, চাইলেই হাত মুঠো করে হাউমাউ করে কাঁদতে পারছি, জেদ দেখাতে পারছি, সব-সব কিছু করতে পারছি। খুব ইচ্ছে করে বরিশাল ফিরে যেতে।

তবে অমন একলা থাকাটা কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে ক্ষতিকরও বটে। সারাবেলার কথাগুলো কাউকে বলার থাকে না তখন। কাউকে ঠিক খুঁজে পাওয়া যায় না। যে কি না খুব মন দিয়ে শুনবে, হাসবে, একটু বকবে, একটু রাগ হবে, রাগ ভাঙাবে, বোঝাবে। আত্মসম্মান-যুক্তি সবকিছু বিসর্জন দিয়ে তখন যাকে হাতের কাছে পাওয়া যায়, তার কাছেই আশ্রয় নিতে হয়। স্রেফ শোনানোর জন্যে। গল্পের ঝুড়ি শূন্য করে দেবার জন্যে। নয়ত পরের দিনের গল্পগুলো আর রাখবো কোথায়?

একান্তই নিজের বাসা হত, দুটো কুকুরছানা পুষতাম। সময় কাটত কি না জানি না, তবে বিষাদ কেটে যেত নিশ্চিত।

ঢাকায় শান্তিনগরের বাস চুকেছে প্রায় দু’ সপ্তাহ হল। আপাতত সেগুনবাগিচায় ঠাঁই নিয়েছি। স্থায়ী আবাসের চিন্তাভাবনা চলছে, সেটা বাবা-মার দায়। আমার এখন কেন যেন নিজেকে পরিবারের সাথে সম্পৃক্ত লাগে না। কেন এই অদ্ভুত অনুভূতি হয়, আমি জানি না। স্রেফ মনে হয়, আমি আর কত দিন আছি এখানে? আমি কেন যুক্তি দেব? তাদের পছন্দটুকুই মেনে নিই। আমি এখন অতিথিমাত্র।

সত্যি বলতে, বরিশালের ওই চারদেয়ালটুকুই আমার আপন মনে হয় সবচে বেশি।

ভোর হয়ে গেছে। সাড়ে পাঁচটা প্রায়। আটতলায় বসে ওপাশে রাজউকের টিকটিক ঘড়ি আর এপাশে কার্জন হল আঁধার কেটে বেরিয়ে এসেছে বহুক্ষণ হল, দেখতে পাচ্ছি বেশ। আমার দিনের বেশিরভাগ সময় কেটে যায় এ জানলার পাশে বসে। জুলাই মাসের এই প্রচণ্ড গরমেও দখিন হাওয়া আর খোলা আকাশটুকুর জন্যেই হয়ত এখন মাঝেমধ্যে ঢাকা আসতে চাইব।

মাঝেমধ্যে কিংবা স্পষ্ট করে বললে, অধিকাংশ সময় ভীষণ ইনফেরিওরিটি কমপ্লেক্সে ভুগি আজকাল। এর বাংলা কি, হীনম্মন্যতা? (নাকি হীনমন্যতা? বানান ভুল মার্জনীয়।) নিজের ক্ষতবিক্ষত মুখ, কোনোকিছুতেই অতি দক্ষ হতে না পারা, আত্মবিশ্বাসের অভাব, ব্যাকডেটেড আর ন্যারো চিন্তাভাবনা, অতি সাধারণ পোশাকআশাক, অতি প্রিয় মানুষগুলোকে হারিয়ে ফেলবার ইনসিকিউরিটি- সবকিছু নিয়ে বড় হীন লাগে নিজেকে। কেবলই মনে হয়, আমি ঠিক কোথাও খাপ খাওয়াতে পারছি না।

আমি ঠিক জানি না, আমি কোথাও খাপ খাওয়াতে পারব কি না। সে জানতে আমি আগ্রহীও নই। তেলাপোকার মত টিকে রইলাম না হয়। আপডেটেড আর ব্রড মাইণ্ডেড পৃথিবীর মানুষের তাড়া খেয়ে ঘরের কোণায় কোণায় ছুটে বেড়ালাম নাহয়। কার কি দায় পড়েছে আমাকে মেনে নেবার? আমার ইনসিকিউরিটিকে গ্রাহ্য করবার?

মানুষ বড় ব্যস্ত প্রাণী। ইনসিকিউরিটি, ডমিনেন্স, মায়া- এইসব তুচ্ছ জিনিসে তাদের ব্যয় করবার মত মুহূর্তের ভগ্নাংশটুকুও নেই। যদিওবা ব্যয় হয়, সে হতে হবে রূপসী কিংবা রূপবান, উদার আর মনে ইনসিকিউরিটির কণাটুকুও না থাকা মানুষ। পৃথিবীর অগুণতি মানুষ আছে এমন। তার মাঝে আমরা দু’একজন বাতিল মানুষ পড়ে গেছি…

তাদের মাঝে আমি আর স্থান করে নেবো কিভাবে?

ইতি,

কাঠপুতুল

1 thoughts on “হঠাৎ দু’কলম..

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান